বিরল সব পাখির কলোনি 

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামের পাখি কলোনি
ছবি: শিবলী সাদিক

জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া গ্রাম। গ্রামজুড়ে শুধুই পাখির ডাক। এক বাঁশঝাড়েই প্রায় এক হাজার পাখির বাসা। প্রায় ১০০ বছরের পুরোনো এই পাখি কলোনি এ দেশের সবচেয়ে পুরোনো পাখির আশ্রয়স্থলের একটি। পুরো কলোনি এলাকাটি মাত্র ১ দশমিক ২ হেক্টর। এর ভেতরেই প্রায় কয়েক হাজার পাখির বসবাস। বাঁশঝাড় ছাড়াও এখানে তেঁতুল, আম, বটগাছসহ মোট আট জাতের গাছে পাখিগুলো আশ্রয় নেয়।

পুরো কলোনিতে সাত জাতের পাখির নিয়মিত বাস। কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েক বছর ধরে বিরল এক জাতের পাখি এখানে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। তা–ও আবার সংখ্যায় তিন শতাধিক। পাখিটির নাম খয়রা কাস্তেচরা। সাধারণ মানুষের কাছে পাখিটি খুব বেশি পরিচিতও নয়। অনেকে এই পাখির উপস্থিতি খেয়ালও পর্যন্ত করতে পারেননি। 

ক্ষেতলালের এই পাখি কলোনিটি আমার খুব চেনা। প্রায় এক যুগ ধরে এর খোঁজখবর রাখি কিন্তু খয়রা কাস্তেচরার আশ্রয় নেওয়ার খবর কখনোই শুনিনি। এই খবর দিলেন পাখি কলোনি গবেষক শিবলি সাদিক। তিনি বন অধিদপ্তরের একমাত্র পক্ষিবিদ। দীর্ঘদিন ধরে পাখি কলোনি নিয়ে কাজ করছেন। খয়রা কাস্তেচরার এই খবর শুনে আরও কয়েকটি পাখি কলোনিতে এই প্রজাতির আশ্রয় নেওয়ার খবর পেলাম। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার রামনগরের একটি কলোনিতেও এই জাতের ৬০-৭০টি পাখি দেখা গেছে। আরও দেখা গেছে নওগাঁর মহাদেবপুরের আলীদেওনা গ্রামের পাখি কলোনিতে। সেখানে খয়রা কাস্তেচরা পাওয়া গেছে মাত্র ২০-২৫টি।

খয়রা কাস্তেচরার এই খবরে আমি একেবারেই অবাক হলাম। এই প্রজাতির পাখি এ দেশে পরিযায়ী। মূলত শীতকালে আমাদের দেশে আসে খাবারের সন্ধানে। এই প্রজাতির পাখি দেখার জন্য একসময় অনেক জায়গায় গিয়েছি।

বিরল এই প্রজাতির দেখা প্রথম মিলেছিল ২০১১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গুয়ার হাওরে। সংখ্যায় ছিল মাত্র তিনটি। এরপর ২০১৪ সালে ১০টি পাখির একটি দল দেখা যায়। ২০১৬ সালে পাখির এই দলটি আরও বড় হতে থাকে। সে বছর দেখা মেলে ৭৭টি পাখি এবং তার পরের বছর তা হয়ে দাঁড়ায় ১৫০টি পাখির একটি বড় দল। এখন সারা দেশে কয়েক হাজার খয়রা কাস্তেচরার দল। এই পাখি যে এ দেশে এখন কলোনি করে মানুষের উঠানে এসে থাকবে, তা ভাবতেই অবাক লাগে।

বাংলাদেশে পাঁচ শতাধিক ছোট–বড় পাখি কলোনি আছে। অনেক পাখি কলোনি আছে, যার বয়স প্রায় ২০০ বছর। বেশির ভাগ এই কলোনিগুলো ব্যক্তিমালিকানাধীন মানুষের বাগানে দেখা যায়। বক, বগলা, পানকৌড়ি, শামুকখোল, গয়ার, খয়রা কাস্তেচরা এই কলোনিগুলোর প্রধান পাখি। সব মিলিয়ে তিন লাখ থেকে পাঁচ লাখ পাখির আশ্রয়স্থল হলো এই জায়গাগুলো। এর বাইরে এই পাখিগুলোর টিকে থাকার আর জায়গা নেই।

গত পাঁচ বছরে ৮০টির বেশি পাখি কলোনি পাখিশূন্য হয়েছে বলে গবেষণায় উঠে আসছে। আর নতুন পাখি কলোনি খুঁজে পাওয়া গেছে মাত্র পাঁচটি। এখন প্রশ্ন হলো পাখিশূন্য কলোনিগুলোর পাখি কোথায় গেল। এগুলোর পাখি ওই কলোনিগুলোতে নিরাপদ নয় বলেই অন্য কলোনির সঙ্গে হয়তো মিশে গেছে।

পাখি কলোনিগুলোতে সরকারি নজরদারি খুব বেশি নেই। সম্প্রতি বন অধিদপ্তর এ দেশের পাখিগুলোর ওপরে একটি জরিপ করছে। এর নেতৃত্বও দিচ্ছেন পক্ষিবিদ শিবলী সাদিক। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে নানান তথ্য। বেশির ভাগ কলোনিই এখন হুমকির মধ্যে আছে। সিলেট, ময়মনসিংহ এলাকায় অবস্থিত পাখির এসব কলোনিতে প্রচুর পাখির বাচ্চা শিকার হয়। শিকার করা এই পাখিগুলো চলে যায় খাবারের হোটেলগুলোতে। অথচ এই কলোনিগুলো পাখি সংরক্ষণের বড় এলাকা। এখনই কিছু এলাকাকে সরকারের প্রণোদনার আওতায় নিয়ে এসে পাখিগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল নিশ্চিত করতে হবে। তবে কোনোভাবেই বাগানমালিকদের কাছ থেকে জায়গাটুকু নেওয়া যাবে না।

টাঙ্গুয়ার হাওরের বাঙ্গালভিটায় একটি গারো পাড়া আছে। এই পাড়ার একটি বাড়ির উঠানে একঝাঁক পাখি বাস করে যুগ যুগ ধরে। পাখির বিষ্ঠা পড়ে ঘরের চাল নষ্ট হয়েছে। তবু বাড়ির মালিক এই পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দেননি। প্রায় প্রতিবছরই আমি এই কলোনি দেখতে যাই। এ রকম মানবিক দৃষ্টান্ত বেশির ভাগ কলোনির মালিকেরা তৈরি করতে পেরেছেন বলেই পাখিগুলো টিকে আছে। এখন পরের প্রজন্মের পালা এই জায়গাগুলো পাখির নিরাপদ অঞ্চল করে দেওয়া।