‘ষাইট্টা বটগাছ’–এর খোঁজে ধামরাই সদর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ২০ আগস্ট, মঙ্গলবার বিকেল চারটা। গাড়ি চলছে। ধারণা ছিল তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যেই জায়গাটির নাগাল পাওয়া যাবে। কিন্তু পথ আর ফুরায় না। গাড়ি থামিয়ে দোকানের গদিতে বসা কোনো প্রবীণ কিংবা চায়ে চুমুক দিতে থাকা কোনো তরুণকে যতবারই জিজ্ঞেস করি, সবার এক কথা—‘এই তো সামনে’, সোজা নাক বরাবর গিয়ে হাতের বাঁয়ে ঢুকে সামান্য ডানে গেলেই ‘ষাইট্টা বটগাছ’।
কিন্তু এতটুকু ‘দিকনির্দেশনা’ও সামনে আরও দশজনকে জিজ্ঞেস করতে হলো। কারণ, সব রাস্তা প্রায় একই রকম। পথ হারালেই বিপদ। ‘পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি’—এ গান গাওয়ার সুযোগ কম ছিল, কারণ গাড়িতে জ্বালানি কমে যাওয়ার সংকেত বাজছে। ‘টেনশন’ যতই থাকুক, দুপাশের সৌন্দর্য সব ভুলিয়ে দিচ্ছিল। একটু পরপর বাজার, পাকা সাগর কলা, পাকা পেঁপেসহ নানা দেশি ফলফলাদি নিয়ে বসেছেন গ্রামের বিক্রেতারা। সড়কের দুপাশে পাট ও আউশ ধানের খেত। হরেক রকম সবজিগাছের বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা। চারদিকে এত সবুজ, মনটাকে প্রশান্তি দিচ্ছিল সন্দেহ নেই।
এই ধামরাই তো ঢাকারই অংশ। রাজধানী থেকে কত কাছে! চার শ বছরের নগরীতে সবুজের অভাবে আমরা হাঁসফাঁস করি। অথচ দুপা বাড়ালেই ধামরাই কতটা সবুজ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে।
ভাবতে ভাবতেই ষাইট্টা বটগাছের তলায় পৌঁছে গেলাম। মনে করেছিলাম একসঙ্গে বোধ হয় ষাটটি বটগাছ আছে, তাই এমন নাম। পরে বুঝলাম এই গ্রামের নাম ষাইট্টা, আর ইউনিয়ন হলো যাদবপুর।
প্রকৃতিতে তখন শরৎ কেবল শুরু হয়েছে। গন্তব্যে যেতে যেন বেশ তাড়াহুড়া করছে শেষ বিকেলের সাদা সাদা মেঘ। তবে গুমোট গরমের কথা এড়িয়ে যাই কী করে!
পর্যটকও আছেন আঠারো-কুড়ি জন। কেউ বটগাছের ডাল ধরে ঝুলছেন, কেউ সদলবলে গাছে উঠে যাচ্ছেন। কেউ পাতার ফাঁকে লুকিয়ে পড়ছেন। সব দৃশ্যই বন্দী হচ্ছে ক্যামেরায়। এক পাশে চানাচুর, মুড়ি আর ছোলার মিশেলে তৈরি হচ্ছে ‘ঘটি গরম’।
খেয়াল করে দেখলাম, গাছটিতে ফল আছে ঢের। প্রজাতিভেদে বটগাছে সারা বছরই ফল দেখা যায়। উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, বটগাছের পাকা ফলের খাদ্যমান খুব ভালো। পর্যাপ্ত ভিটামিন, শর্করা ও মিনারেল থাকে। তাই ফলটি পাখিদের দারুণ পছন্দ। প্রথম আলোয় বন্য প্রাণী–গবেষক সীমান্ত দীপুর একটি লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, বটগাছে ৪০ প্রজাতির বেশি পাখি খাবার খেতে আসে। হলদে পা সবুজ হরিয়াল, ছোট বসন্তবাউরি, এশীয় কোকিল, শালিকের দেখা মেলে বেশি। গান গেয়ে খাবার খায় আর পুরো এলাকা মুখর করে রাখে। পাখিদের কোনো কোনো প্রজাতি গাছের নিচের শাখায়, আবার কোনোটি ওপরের ডালে খাবার খোঁজে।
সঙ্গে আমার দুই বান্ধব। একজন স্থানীয়, আরেকজন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা—কাতারপ্রবাসী। আমরা আর দশজনের মতো চারপাশটা ভালোমতো দেখে, বেজায় ছবি তুলে বটতলার পাশে চায়ের দোকানে বসলাম। চা-বিস্কুট, কেক, পানি, একটা-দুটো মিষ্টি আইটেম, সবই এ দোকানে পাওয়া যায়। দোকানের সামনে ক্রেতাদের বসার সুব্যবস্থা। পেছনে নাবাল জমিতে পাটখেত।
বিকেল তখন সন্ধ্যার পথযাত্রী। দোকানে জনা আটেক বয়সী মানুষ বসে আছেন। প্রতিদিনই বসেন। আমরা গল্প জুড়ে দিই। ষাইট্টা বটগাছের যতটুকু ইতিহাস জেনে এসেছি, মিলিয়ে নিই।
তাঁদের কেউ বললেন, ষাইট্টা বটগাছের বয়স হবে চার শ বছর, কেউ বললেন পাঁচ শ। তবে সরকারের জাতীয় তথ্য বাতায়নে ষাইট্টা বটগাছের বয়স দুই শ বছর উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ষাইট্টা গ্রামে দেবীদাস নামে একটি বংশ ছিল। তাঁদের পূর্বপুরুষেরা পাশাপাশি একটি বট ও একটি পাকুড়গাছের চারা রোপণ করেন। পাকুড়গাছকে পুরুষ আর বটগাছকে নারী বিবেচনা করে গাছ দুটির মধ্যে বিয়ে দেওয়া হয়। সেই গাছের সন্তানেরা এখন ছড়িয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে কি, এখন গাছের তলায় গেলে কোনটা মূল গাছ আর কোনটা শিকড়, বোঝা যায় না। প্রায় পাঁচ বিঘা জমিতে বিস্তৃতি পেয়েছে মূল কাণ্ড ও শাখা–প্রশাখা। এমনিতেই বটগাছের ছড়ানো শাখা থেকে ঝুরি মাটিতে নেমে আসে ও ক্রমে কাণ্ডের আকারে স্তম্ভমূলে রূপান্তরিত হয়। বয়স্ক গাছ বিশালাকৃতি আচ্ছাদন তৈরি করে। এই গাছটিও তাই করেছে।
লোকজ বিশ্বাস হলো, ষাইট্টার এই গাছের ডাল কাটা যাবে না। যে ডাল কাটবে, সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমন ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে বলে জানালেন প্রবীণেরা। তা ছাড়া ভক্তি-শ্রদ্ধার জন্য বটগাছের নিচে মন্দিরও বানিয়েছেন তাঁরা। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে এই গাছের তলায় হয় হরেক আয়োজন।
ধামরাই দূরের কোনো জনপদ নয়। ঢাকা থেকে যেকোনো যানে ধামরাই এসে অটোরিকশায় চড়ে যাওয়া যায় ষাইট্টা গ্রাম। যদি প্রাণ-প্রকৃতিকে ভালোবাসেন, তবে একটা দিন লোকালয়ের সৌন্দর্য বাড়ানো এই অতিপ্রাকৃত গাছটিকে ছুঁয়ে দেখে আসতে পারেন।