প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

প্রচণ্ড গরমে স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিবন্ধীদের বেশি

গরমে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি চিকিৎসা খরচও বাড়ে। হাসপাতাল ও পরিবারকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ।

অতিরিক্ত গরম বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবাই বিপদে পড়েন। তবে এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিবন্ধী মানুষের তুলনামূলকভাবে বেশি।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বা উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় হওয়া এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে। দেশটির সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির ১১ গবেষক প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে গবেষণাটি করেছেন। এ বছর ৮ এপ্রিল স্বাস্থ্য সাময়িকী ল্যানসেট এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে।

গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব স্বাস্থ্যের ওপর কতটা গভীরভাবে পড়ে, তা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক গবেষণা হয়েছে। তবে এই গবেষণায় প্রতিবন্ধী মানুষের স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়টি দেখার চেষ্টা হয়েছে।

আমাদের হাসপাতালে রোগী দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই গবেষণা ফলাফলের মিল আছে।
অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল

গবেষণায় দক্ষিণ কোরিয়ার হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা ২৩ হাজার ৭৯২ জন প্রতিবন্ধী মানুষ এবং ১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৭৪ জন প্রতিবন্ধী নন, এমন মানুষের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। এসব রোগী ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হাসপাতালে এসেছিলেন।

গবেষকেরা বছরের বিভিন্ন সময়ের দৈনিক তাপমাত্রার তথ্য নিয়েছিলেন ইআরএ৫-ল্যান্ড নামের বৈশ্বিক ডাটাসেট (তথ্যভান্ডার) থেকে। গবেষণার বছরগুলোতে গড় তাপমাত্রা ছিল ২২ দশমিক ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

গবেষকেরা দেখেছেন, এক লাখ মানুষের মধ্যে প্রতিবছর ২ হাজার ২২০ জন প্রতিবন্ধী মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। অন্যদিকে এক লাখ মানুষের মধ্যে ৯৮৩ জন প্রতিবন্ধী নন, এমন মানুষ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসেন।

বাংলাদেশের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধী মানুষের ওপর প্রচণ্ড গরম বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। আমাদের হাসপাতালে রোগী দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে এই গবেষণা ফলাফলের মিল আছে।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস প্রতিবেদন-২০২২ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজার মানুষের ২৫ দশমিক ৫ জন কোনো না কোনো ধরনের প্রতিবন্ধিতার শিকার। অন্যদিকে দেশে গরম বাড়ছে। গত এপ্রিলে ৭৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দিন তাপপ্রবাহ ছিল।

কোরিয়ায় হওয়া গবেষণায় খরচের হিসাবও দিয়েছেন গবেষকেরা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতি এক লাখ প্রতিবন্ধী মানুষের বছরে খরচ হয় প্রায় ১ কোটি ২১ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ১৪২ কোটি টাকা)। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী নন, এমন এক লাখ মানুষের জরুরি বিভাগে খরচ হয় প্রায় ৮১ লাখ ডলার (প্রায় ৯৫ লাখ টাকা)। এর অর্থ, একজন প্রতিবন্ধী বছরে জরুরি বিভাগে প্রতিবন্ধী নন এমন মানুষের চেয়ে ৩৯ ডলার বেশি খরচ করেন। আর্থিক ঝুঁকি প্রতিবন্ধী মানুষের বেশি।

কোরিয়ায় তাপমাত্রা বেশি থাকে জুলাই-আগস্ট মাসে। এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী মানুষকে হাসপাতালে আসতে দেখা গেছে। প্রচণ্ড গরমের কারণে বছরে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে বাড়তি ২৮ জন প্রতিবন্ধী হাসপাতালে আসেন। অন্যদিকে প্রতিবন্ধী নন, এমন বাড়তি মানুষ আসেন ছয়জন।

ব্যাখ্যা কী

তিনটি বিষয় প্রতিবন্ধী মানুষকে ভঙ্গুর অবস্থায় রাখে—গরমের সংস্পর্শে থাকার স্থায়িত্বকাল, গরমের প্রতি সংবেদনশীলতা এবং পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য। যদি কোনো ব্যক্তির চলনশক্তির সমস্যা থাকে, তা হলে তিনি ঝুঁকি এড়াতে পারেন না। যদি কোনো ব্যক্তির বোধশক্তি সক্রিয় না থাকে, তা হলে তিনি স্বাস্থ্যঝুঁকি বা চাহিদা বুঝতে পারেন না।

কয়েকটি কারণ প্রচণ্ড গরমে প্রতিবন্ধী মানুষের ঝুঁকি বাড়ে। প্রথমত, চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ও কিছু ওষুধের কারণে প্রতিবন্ধী মানুষ গরমের সঙ্গে শারীরিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, নানা বাধা বা নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিবন্ধী মানুষ সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন না। অনেক কাজ থেকে তাঁরা দূরে থাকেন। গরম সহ্য করার বা গরম প্রতিহত করার ক্ষমতা তাদের থাকে না।

অন্য একটি সূক্ষ্ম বিষয় গবেষকদের চোখে পড়েছে। তাঁরা দেখেছেন, গরমের কারণে হাসপাতালে আসা প্রতিবন্ধী পুরুষের চেয়ে প্রতিবন্ধী নারীর ঝুঁকি বেশি। প্রতিবন্ধী নয়, এমন নারী-পুরুষে ঝুঁকির পার্থক্য নেই।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই গবেষণায় দিকনির্দেশনাও আছে। তা হলো, হাসপাতালে প্রতিবন্ধী এলে তাঁরা যেন আগে সেবা পেতে পারেন, সহজে সেবা পেতে পারেন, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তীব্র গরমের সময় পরিবারকেও প্রতিবন্ধী সদস্যের ব্যাপারে সচেতন আচরণ করতে হবে।