মনোলোভা সর্পগন্ধা
ঢাকায় দু-একটি বাগানে সর্পগন্ধা দেখেছি অনেক বছর আগে। ফুল বেশ আকর্ষণীয় হওয়ায় দৃষ্টি কেড়েছিল। ২০১৮ সালের দিকে মধুপুর বনে কয়েকটি গাছ দেখে নিশ্চিত হলাম সর্পগন্ধা আমাদের দেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে। সর্বশেষ মে মাসে গাজীপুরের শালবনেও কিছু গাছ দেখেছি। তবে সংখ্যায় কম। প্রায় ২৫ বছর দেশের বনবাদাড়ে ঘুরে মাত্র দুটি স্থানে প্রাকৃতিক আবাসে দেখা গেল গাছটি। এই চিত্র থেকেই সর্পগন্ধার বাস্তব পরিস্থিতি অনুমান করা যায়। বনাঞ্চল উজাড় হতে থাকায় প্রাকৃতিক আবাস থেকে গাছটি হারিয়ে যেতে বসেছে। সর্পগন্ধা প্রধানত ঔষধি গুণের জন্য বিখ্যাত। এ কারণে অনেক বাগানেই গাছটি সংরক্ষণ করা হয়। আবার ফুলের সৌন্দর্যও কম নয়।
গোলাপি আর লালের মিশেলে অপূর্ব রঙের কারুকাজ। গাছটির সর্পগন্ধা নামের সঙ্গে কি আদৌ সাপের কোনো সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান স্নেকরুট’ থেকে বাংলা নামকরণের যথার্থতার একটা সূত্র পাওয়া যায়। ভেষজশাস্ত্রমতে, গাছটি বিষধর সাপের দংশনে প্রাথমিক চিকিৎসায় বেশ কার্যকর। প্রকৃত অর্থেও এ গাছ চমৎকার ঔষধি গুণসম্পন্ন। প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে সর্পগন্ধার অবস্থান পাকাপোক্ত। শুধু ভেষজ চিকিৎসায়ই নয়, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায়ও এর উপযোগিতা রয়েছে। কবিরাজরা উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, অধিক উত্তেজনা, কালাজ্বর, পেটব্যথা, পেটের পীড়া ইত্যাদি জটিল রোগে গাছের পাতা, কাণ্ডের রস ও শিকড় থেকে প্রতিষেধক তৈরি করেন। পরিসংখ্যানমতে, এ গাছের বার্ষিক চাহিদা ১ হাজার টনের বেশি।
সর্পগন্ধার (Rauvolfia serpentina) প্রচলিত অন্য নাম সর্পাদনী ও সর্পক্ষী। সৌন্দর্যের বিচারেও গাছটি অনন্য। গুল্মশ্রেণির ছোট গাছ, ১ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা লম্বাটে, উজ্জ্বল সবুজ, ঘনবদ্ধ। কাণ্ডের আগায় একগুচ্ছ গোলাপি ফুল, ফোটে গ্রীষ্ম থেকে শরৎ পর্যন্ত। ফল পর্যায়ক্রমে প্রথমে সবুজ, পরে কালো বা নীলচে-কালো, পাকে বর্ষায়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে ফল সংরক্ষণ করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় দেশেই সর্পগন্ধা সহজলভ্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন বাগান ছাড়াও দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রামে বিক্ষিপ্তভাবে চোখে পড়ে। বংশবৃদ্ধি বীজ ও শাখা কলমে।
অনেক গুণের জগৎমদন
এই গাছ গ্রামে একসময় অঢেল ছিল। সাধারণত বেড়ার কাজে গাছটি বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা গেছে। এখন দশ গ্রাম ঘুরলেও একটি গাছ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সম্প্রতি গাজীপুরের কাপাসিয়ার রায়েদ গ্রামে একটি মাঠের ধারে জগৎমদনের ছোট্ট দুটি ঝোপ দেখেছি।
ঢাকায় মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও আছে। প্রায় সারা দেশে বেড়ার জন্য ব্যবহৃত হলেও গাছটি কিন্তু ঔষধি গুণে অনন্য। অবশ্য ডালপালার বিন্যাস ও পাতার সৌন্দর্যের জন্যও এই গাছ কম সমাদৃত নয়। জগৎমদন স্থানীয়ভাবে বিশাল্লা বা বিষজারণ নামেও পরিচিত। এই গাছের পাতা ও মূলের ছাল বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে কাজে লাগে। প্রধানত গাব্যথা, দাঁতের মাড়ি ফোলা ও ব্যথা, হাঁপানি, ফোড়া, পেটব্যথা, বমি, সর্দি–কাশি ও যকৃৎ বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে জগৎমদনের মূল ও পাতা অত্যন্ত কার্যকর। এ ছাড়া সর্দি–কাশিতে পাতা বেটে রস পানিতে মিশিয়ে পরিমাণমতো খেতে হয়। আবার বাসকের বিকল্প হিসেবে ঠান্ডাজনিত রোগেও গাছটির লোকজ ব্যবহার রয়েছে।
জগৎমদন (Justicia gendarussa) বহুবর্ষজীবী গুল্মজাতীয় ছোট উদ্ভিদ। কাণ্ড সবুজ, ১ থেকে দেড় মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। পাতা বর্ষাফলাকৃতির, কিনারা কর্তিত, উজ্জ্বল ও রোমশ। পাতার মধ্যশিরার রং বেগুনি। ফুল ছোট, সাদা অথবা ঈষৎ গোলাপি, পাপড়ি ১ দশমিক ২৫ সেমি লম্বা ও তরবারি আকৃতির। ফুলের মৌসুম এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত বিস্তৃত। ফল পাকে বর্ষার শুরুতে। ভেষজ চিকিৎসার প্রয়োজন অথবা প্রজাতি সংরক্ষণের তাগিদে—যেকোনো কারণেই গাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক