এখন যতটুকু বৃষ্টি হওয়া দরকার, তা হচ্ছে না। এতে বায়ুদূষণ বাড়ছে। বেড়েছে শ্বাসকষ্টের রোগীও।
‘এসো করো স্নান নবধারা জলে বলবে কে আর/ শহরে বৃষ্টি জল–কাদা মাখা নোংরা দেদার’—নগরজীবনে বর্ষার বিড়ম্বনা এভাবেই উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের গায়ক কবির সুমনের গানে। দুই কোটি মানুষের নগর ঢাকার রাস্তাঘাটে বর্ষার জল-কাদা পরিচিত বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বায়ুদূষণ। বর্ষার সময় সাধারণত বায়ুদূষণ কম থাকে। কিন্তু এবার বর্ষা মৌসুম বা জুলাই-আগস্টে বায়ুর দূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এমনকি গত আগস্টে বায়ুদূষণ আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ বায়ুদূষণ ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলছে। জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইডিসিএইচ) এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই ও আগস্টের তুলনায় এ বছর ঢাকায় শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
ঢাকার বায়ুর মান নিয়মিত বিশ্লেষণ করে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া বায়ুমান সূচক (একিউআই) বিশ্লেষণ করে এবারের আগস্টের বায়ুর এ অবস্থা তুলে ধরেছে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন শীতকালের বা শুষ্ক মৌসুমের বায়ুদূষণ আমাদের ভাবনার বিষয় ছিল। এখন বর্ষাকালেও দূষণ বাড়ছে। এটা নতুন চিন্তার বিষয়।’
বায়ুদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের ফুসফুস। অভিজ্ঞতায় দেখছি, যাদের অ্যাজমা নেই, তাদের তা শুরু হয়েছে। আবার অ্যাজমা রোগীদের কষ্ট বেড়েছে। বায়ুদূষণের কারণে যক্ষ্মারোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।আবদুস শাকুর খান, বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ
কিছু নম্বর বা স্কোরের ভিত্তিতে বায়ুর মান নির্ধারিত হয়। যেমন স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তা ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তা ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে এর ওপরের স্কোরকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়।
আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষাকাল। ইংরেজি জুলাই ও আগস্ট মাসে বর্ষাকালের বেশির ভাগটাই পড়ে। দেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বায়ুদূষণ বেশি থাকে। এরপর তা কমতে শুরু করে।
গত আট বছরের জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ ছিল। এর গড় স্কোর ছিল ২৪৮। দূষণের দিক থেকে এরপর আছে ফেব্রুয়ারি, ডিসেম্বর, মার্চ, নভেম্বর, এপ্রিল, অক্টোবর, মে, জুন, সেপ্টেম্বর, আগস্ট ও জুলাই।
আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ু, যা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব দূষণের উৎস বন্ধে সরকারি পর্যায়ে জোরদার কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
ক্যাপসের হিসাবে, চলতি বছরের জুলাই মাসে ঢাকার বায়ুর গড় মান ছিল ৯৩। আট বছরের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত মাস। গত বছর ছিল সবচেয়ে দূষিত, মান ছিল ১০৯।
তবে জুলাইয়ের তুলনায় এবারের আগস্ট অনেক দূষিত। ক্যাপসের হিসাবে, এবার আগস্টের বায়ুর গড় মান ১৩৩; যা আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল গত বছরের আগস্ট, বায়ুর মান ছিল ১০৫। দেখা যাচ্ছে, দুই বছর ধরে জুলাই ও আগস্টে বায়ুর মান বেশ খারাপ রয়েছে।
ঢাকার দূষণে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের ভূমিকা আছে। তবে অন্য কারণগুলোও অস্বীকার করছি না।পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোতালিব
সরকার, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকায় বায়ুদূষণের বড় উৎস। এসবের উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলা নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের ধোঁয়া। এ ছাড়া আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ু, যা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এসব দূষণের উৎস বন্ধে সরকারি পর্যায়ে জোরদার কোনো তৎপরতা দেখা যায় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোতালিব বলেন, ‘ঢাকার দূষণে উপমহাদেশীয় বায়ুপ্রবাহের ভূমিকা আছে। তবে অন্য কারণগুলোও অস্বীকার করছি না।’
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফিরোজ খান বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের যেসব উৎস, তা সব ঋতুতে প্রায় একই রকমের দূষণ ঘটায়। বৃষ্টিতে দূষণের মাত্রা কমবেশি হয়। কিন্তু উৎস বন্ধ হচ্ছে না। এখন বৃষ্টির চেহারা পাল্টে যাচ্ছে। যতটুকু বৃষ্টি হওয়ার দরকার, তা হচ্ছে না। এতে বর্ষায় বায়ুদূষণ বাড়ছে।
রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছরের জুলাই ও আগস্টে প্রতিষ্ঠানটিতে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আউটডোর, জরুরি বিভাগসহ সব জায়গায় রোগীর সংখ্যা এবার বেশি।
গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। গত বছরের আগস্টে ১৩ হাজার ছাড়িয়েছিল রোগীর সংখ্যা। এবার তা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ আবদুস শাকুর খান গত সোমবার বলেন, ‘হাসপাতাল ও ব্যক্তিগত চেম্বারে শ্বাসকষ্টের রোগী বাড়তে দেখছি। বায়ুদূষণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের ফুসফুস। অভিজ্ঞতায় দেখছি, যাদের অ্যাজমা নেই, তাদের তা শুরু হয়েছে। আবার অ্যাজমা রোগীদের কষ্ট বেড়েছে। বায়ুদূষণের কারণে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে।’