বনের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২০০টির বেশি ক্যামেরা বসিয়ে ও পায়ের ছাপ দেখে গণনা।
দুই-তৃতীয়াংশ জরিপের এলাকায় ছয়টি পরিবারসহ বাঘ দেখা গেছে।
বাঘ রক্ষায় নেওয়া উদ্যোগ চালু রাখলে বাঘের সংখ্যা ১৫০–এ উন্নীত করা সম্ভব।
সুন্দরবনের খুলনা অংশে বেঙ্গল টাইগারের আনাগোনা বেশ কমে গিয়েছিল। গতবার ওই এলাকার প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় জরিপ করে পাওয়া গিয়েছিল মাত্র দুটি বাঘ। তবে আশার কথা, সেই এলাকায় আবার বাঘ বাড়তে শুরু করেছে। চলতি বছর শুরু হওয়া বাঘ জরিপে খুলনা অংশে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি বাঘ দেখা গেছে। দুই বাচ্চাসহ বাঘের একাধিক পরিবার দেখা গেছে। ওই এলাকায় বাঘের প্রধান খাবার হরিণের সংখ্যাও আগের তুলনায় বেড়েছে।
সুন্দরবনের প্রায় চার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় চলমান জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে বন বিভাগ এসব তথ্য পেয়েছে বন বিভাগ। বন বিভাগের জরিপকারী দলটি বলছে, সাধারণত সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশে সব সময়ই বাঘ বেশি দেখা যায়। এবার সেখানেও গতবারের চেয়ে বেশি বাঘ দেখা গেছে। শিশু বাঘের সংখ্যাও গতবারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সামগ্রিকভাবে গতবারের চেয়ে এবার সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে।
আগেরবার সুন্দরবনের খালে প্রতি দুই কিলোমিটারে বাঘের একটি পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল। নতুন জরিপে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্র বলছে, এবার জরিপের অন্যতম উদ্দেশ্য—সুন্দরবনে বাঘ কম আছে এমন এলাকা, যেমন খুলনায় বাঘের সংখ্যা বাড়ানো। এ জন্য যেখানে বাঘ বেশি আছে, সেখান থেকে এনে খুলনা অঞ্চলে ছাড়া হবে। তবে জরিপে এবার খুলনা অংশে ধারণার চেয়ে বেশি বাঘ পাওয়া গেছে। এখন প্রকল্পের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করে খুলনায় থাকা বাঘের সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে।
সুন্দরবনের বাঘ নিয়ে করা ওই জরিপ নিয়ে কথা হয় ভারতের বাঘ গণনা জরিপ-২০১৫-এর প্রধান পরামর্শক, বাংলাদেশের বাঘ গণনা জরিপপদ্ধতির প্রধান পরামর্শক এবং ভারতের বন্য প্রাণী ইনস্টিটিউটের প্রধান রাজভেন্দর ঝালার সঙ্গে। ৩ জানুয়ারি প্রথম আলোর পাঠানো প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সুন্দরবনের বাঘের প্রধান খাবার হরিণ। বনে হরিণের সংখ্যা বাড়লে বাঘের সংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। একই সঙ্গে বনে বাঘ শিকার কমায়ও বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে।
সুন্দরবনের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাকে মোট চারটি এলাকায় ভাগ করে জরিপটি করা হচ্ছে। এই কাজে বনের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২০০টির বেশি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। ওই ক্যামেরার সামনে আসামাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঘের ছবি ওঠে। ওই ছবি বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। শারীরিক গঠন অনুযায়ী বাঘের গায়ের ডোরাকাটা দাগ ভিন্ন ভিন্ন হয়। ওই ধরন দেখে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। আর সুন্দরবনের খালে সাধারণত সব বাঘ পানি খেতে আসে। এতে খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ পড়ে। বাঘের ধরন অনুযায়ী ওই ছাপ ভিন্ন হয়। এভাবে পায়ের ছাপ দেখেও বাঘের সংখ্যা গোনা হয়।
আমাদের পুরো জরিপ চলতি বছরের আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসের (২৯ জুলাই) আগে শেষ হবে। ওই সময়ের মধ্যে আমরা জরিপের ফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করব।প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন
জরিপের অংশ হিসেবে সুন্দরবনের ১ হাজার ২০০টি খাল সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। আগের জরিপগুলোতে খালের দুই পাশের প্রতি দুই কিলোমিটার এলাকায় একটি বাঘের পায়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল। এবার প্রতি কিলোমিটারে একটি ছাপ দেখেছে গবেষক দলটি। এই ছাপ সুন্দরবনের বাঘের বিচরণ বৃদ্ধি ইঙ্গিত করে।
জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় স্মার্ট পাহারা চালু করেছি। সুন্দরবনে যেসব দস্যু এত দিন বাঘ হত্যাসহ নানা অপরাধে জড়িত ছিল, তাদের বেশির ভাগ আত্মসমর্পণ করেছে। এ ছাড়া সামগ্রিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনার কারণে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।’
সুন্দরবনের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাকে মোট চারটি এলাকায় ভাগ করে জরিপটি করা হচ্ছে। এই কাজে বনের বিভিন্ন স্থানে ১ হাজার ২০০টির বেশি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনে দস্যুরা নিয়মিত বাঘ শিকার করত। যৌথ অভিযান ও টহল বাড়ানোর ফলে বাঘ সুরক্ষা পাচ্ছে। বাঘের প্রজননহারও বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর বাঘের আক্রমণে দুই থেকে চারজন মানুষ মারা যেতেন। গত পাঁচ বছরে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু কমেছে। দুই বছরে গড়ে দুজন বাঘের আক্রমণে মারা যাচ্ছেন, তা–ও বনের ভেতরে কোনো কাজে এবং মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বাঘের আক্রমণে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মধে৵ অনেকেই বনে অনুপ্রবেশকারী দলের সদস্য ছিলেন।
বন বিভাগ বলছে, সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় বাঘ গণনা করা হচ্ছে। গত বছরের ২৩ মার্চ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছে। এর আওতায় সুন্দরবনের বাঘ স্থানান্তর, অন্তত দুটি বাঘের শরীরে স্যাটেলাইট কলার স্থাপন ও পর্যবেক্ষণ, বাঘের পরজীবী সংক্রমণ ও অন্যান্য ব্যাধি এবং মাত্রা নির্ণয়, উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হবে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক আবু নাসের মোহসিন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পুরো জরিপ চলতি বছরের আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসের (২৯ জুলাই) আগে শেষ হবে। ওই সময়ের মধ্যে আমরা জরিপের ফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করব।’
২০০৪ সালে প্রথম বন বিভাগ ও আইইউসিএন যৌথভাবে সুন্দরবনে বাঘশুমারি করে। পায়ের ছাপ গুনে করা ওই জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০। পরে ২০১৫ সালে প্রথম ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে বাঘের ছবি তুলে এবং পায়ের ছাপ গণনা করে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে বাঘের ওপর জরিপ চালানো হয়।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনভূমি ৪ হাজার ৮৩২ এবং জলাভূমি ১ হাজার ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, এই বনভূমির স্থলে ২৮৯ প্রজাতির প্রাণী আর জলে ২১৯ প্রজাতির প্রাণী বাস করে। ২০১৫ সালের বাঘশুমারি অনুযায়ী, সুন্দরবনে বাঘ ছিল ১০৬টি। আর ২০১৮ সালের শুমারিতে ছিল ১১৪টি।
জানতে চাইলে বাঘ জরিপ দলের অন্যতম সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জরিপ অনুযায়ী ১১৪টি বাঘ পাওয়া গেছে। তবে বনের আয়তন ও বাঘের খাবারের পরিমাণ বিবেচনায় নিলে ওই সংখ্যা ১৫০টিতে উন্নীত করা সম্ভব। এ জন্য বাঘ রক্ষায় নেওয়া উদ্যোগ চালু রাখতে হবে।’