সরকারি দপ্তরের আপত্তিও উপেক্ষা করে যশোরে চলছে ৪ নদীতে ৯ নিচু সেতু নির্মাণ

নয়টি সেতুই নির্মিত হচ্ছে নদীর পানির স্তর থেকে কম উচ্চতায়। এতে এসব সেতুর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যশোর সদর উপজেলার ভৈরব নদের ওপর তিনটি সেতু নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এ রকম নিচু সেতু নির্মিত হলে নৌ–চলাচল ব্যাহত হবে। সম্প্রতি যশোর শহরের দড়াটানায়

যশোর জেলার প্রবহমান চারটি নদ-নদীর ওপর নয়টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। নয়টি সেতুই নির্মিত হচ্ছে নদীর পানির স্তর থেকে কম উচ্চতায়। এতে এসব সেতুর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না। ফলে এসব নৌপথ হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সেতুগুলোর নকশা তৈরিতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমতি নেওয়া হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট (ডব্লিউবিবিআইপি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় নয়টি সেতু নির্মাণ করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। যশোর সদর উপজেলার ভৈরব নদের ওপর তিনটি এবং শার্শার বেতনা, বাঘারপাড়ার চিত্রা ও মনিরামপুরের মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর দুটিটি করে সেতু নির্মিত হচ্ছে। এর মধ্যে চিত্রা নদীর ওপর সেতু দুটি সওজ এবং অপর সাতটি সেতু এলজিইডি নির্মাণ করছে।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারণ, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন ওপর পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।
আবরাউল হাছান মজুমদার, জেলা প্রশাসক, যশোর
খুলনা নগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ময়ূর নদ। বাসাবাড়ির ফেলা ময়লা–আবর্জনা ও কচুরিপানায় ভরে গেছে নদের একাংশ। পানির রং পরিবর্তন হয়ে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ, বাড়ছে মশা। গতকাল খুলনার গল্লামারী এলাকায়

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও তীরভূমিতে স্থাপনাদি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী নৌপথে খুঁটিসহ বৈদ্যুতিক লাইন ও সেতু নির্মাণ করতে হলে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। বিধিমালায় নির্ধারিত মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণির নৌপথের ক্ষেত্রে সেতুর উচ্চতা হবে কমপক্ষে ৬০ ফুট, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ৪০ ফুট, তৃতীয় শ্রেণিতে ২৫ ফুট এবং চতুর্থ শ্রেণির নৌপথে অন্তত ১৬ ফুট উচ্চতায় সেতু নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু যে ৯টি সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, তার সব কটির উচ্চতা ৪ দশমিক ৫৯ ফুট থেকে ১১ দশমিক ৫০ ফুট পর্যন্ত, যা বর্ষা মৌসুমে ছোটখাটো নৌযান চলাচলেও বাধা সৃষ্টি করবে। বিআইডব্লিউটিএর পক্ষ থেকে এসব সেতুর উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানানোর পরও তা আমলে নেওয়া হয়নি।

৯ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিএর একটি প্রতিনিধিদল ভৈরব নদের ওপর নির্মাণাধীন তিনটি সেতু এলাকা পরিদর্শন করে বিস্ময় প্রকাশ করেছে। এসব অপরিকল্পিত সেতুর নির্মাণকাজ অচিরেই বন্ধ করতে বলেছে তারা।

বিআইডব্লিউটিএ খুলনা কার্যালয় ও নওয়াপাড়া নৌবন্দরের উপপরিচালক মো. মাসুদ পারভেজ বলেন, সেতুর নির্মাণকাজ বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মৌখিক ও লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। এখন নির্মাণকাজ বন্ধ করার জন্য এখন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।

বগুড়া শহরের ভেতর দিয়ে ক্ষীণধারায় বইছে করতোয়া নদী। একসময় এখানে বড় নৌযান চলাচল করলেও এখন দখল ও দূষণের ফলে নদীর সেই ভরা যৌবন আর নেই। গতকাল বগুড়া শহরের টিএমএসএস মহিলা মার্কেট এলাকায়

জানতে চাইলে যশোরের জেলা প্রশাসক আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কারণ, প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়ন উপর পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়।’

এলজিইডি যশোর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ভৈরব নদের তিনটি সেতুর মধ্যে রাজারহাট সেতুর নির্মাণকাজ ১৫ শতাংশ, দাইতলা সেতুর নির্মাণকাজ ৫০ শতাংশ ও ছাতিয়ানতলা সেতুর নির্মাণকাজ ৩৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। যশোরের মনিরামপুর উপজেলার হরিদাসকাটি ইউনিয়নের হাজরাইল ও কাটাখালী গ্রামের সীমানা ঘেঁষে মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর একটি গার্ডার সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। সেতুর মূল কাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে সেতুর এক পাশের সম্প্রসারিত অংশ এবং সংযোগ সড়কের নির্মাণকাজ।

মুক্তেশ্বরী নদী চতুর্থ শ্রেণির জলপথের আওতাভুক্ত। চতুর্থ শ্রেণির জলপথে নদ-নদীর ওপর নির্মিত সেতুর উচ্চতা হবে পানির স্তর থেকে গার্ডারের নিচ পর্যন্ত ১৬ ফুট; কিন্তু মুক্তেশ্বরী নদীর ওপর যে সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, তার উচ্চতা পাঁচ ফুটের মতো। সেতু নির্মাণে বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্রও নেয়নি এলজিইডি।

চিঠির পরও আবেদন করেনি এলজিইডি

পয়োনালা, নদীতীরবর্তী বিভিন্ন শিল্প ও ডাইং কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্যে প্রতিনিয়ত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। নির্গত এসব রাসায়নিক বর্জ্যে নদী তার স্বাভাবিক রং হারাচ্ছে, ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের। গতকাল বিকেলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আগানগর এলাকায়

বিআইডব্লিউটিএ খুলনার পশ্চিম বদ্বীপ শাখার নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ আশ্রাফ উদ্দীন বলেন, ‘যশোরের বিভিন্ন নদীর ওপর পাঁচটি সেতু নির্মাণে নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স নেওয়ার জন্য গত ২৪ জানুয়ারি এলজিইডি যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাঁরা নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন করেননি।’

এলজিইডি যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন,‘নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য আবেদন প্রক্রিয়াধীন।’

৩ সেপ্টেম্বর মনিরামপুরের কাটাখালী গ্রামে সরেজমিনে দেখা গেছে, গ্রামের পশ্চিম অংশে উত্তর থেকে দক্ষিণে চলে গেছে মুক্তেশ্বরী নদী। নদী ভরে আছে কচুরিপানায়। নদীর মাঝখানে উঁচু করে কংক্রিটের দেয়াল তুলে ছাদ দেওয়া হয়েছে। সেতুর পূর্ব পাশের সম্প্রসারিত অংশের কাজ শেষ হয়েছে। এখন সেতুর পশ্চিম পাশের সম্প্রসারিত অংশ এবং সংযোগ সড়কের কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। হাজরাইল গ্রামের কমলেশ মণ্ডল বলেন, ‘সেতু আমাদের জন্য খুবই দরকার; কিন্তু সেতুটির উচ্চতা কম। বর্ষাকালে এর নিচ দিয়ে ডিঙিও চলাচল করতে পারবে না।’

ধলেশ্বরী নদীতে অবাধে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। বিনষ্ট হচ্ছে নদীর পরিবেশ। সম্প্রতি সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া এলাকায়

অপরিকল্পিত এসব সেতু নির্মাণ বন্ধ করে নদী বাঁচানোর দাবি জানিয়ে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন, ভবদহ পানিনিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি, ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন, চিত্রা বাঁচাও আন্দোলন ও মুক্তেশ্বরী বাঁচাও আন্দোলন—এই পাঁচ সংগঠন গত ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে স্মারকলিপি দেয়।

এলজিইডি যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্র নিয়ে সেতুগুলো নির্মাণ করা হয়নি, এটা সত্য, তবে সেতুর নিচ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারবে না, এটা সত্য নয়। তিনি বলেন, ‘নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, যশোরের এই নদীগুলো কোন শ্রেণিভুক্ত, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

যে কারণে সেতু নির্মাণের নকশা প্রণয়নে সমস্যা হচ্ছে। শ্রেণিভুক্ত নদীর তালিকা থাকলে আমাদের সুবিধা হতো। নির্মাণাধীন সেতুগুলো নতুন করে সরকারি নীতিমালা মেনে নির্মাণ করা কঠিন হবে।’