চেনা ফুল, অচেনা নাম

বান্দরবানের লামায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বাগানে ফুটেছে চিমাইন
ছবি: লেখক

প্রায় এক দশক আগে বিজ্ঞানলেখক ও বরেণ্য নিসর্গী অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার বাসার বারান্দাবাগানে দুধসাদা রঙের একটি ফুল দেখি। বেশ যত্ন করে লাগানো এই গাছ তিনি নিজেই পরিচর্যা করতেন। ভেবেছিলাম গাছটি নিয়ে তিনি হয়তো কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন! লতানো গাছের এই ফুলগুলো প্রস্ফুটনের দিক থেকে ছিল অক্লান্ত। বারান্দায় বসে তাঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে যখনই অবচেতনে গাছটির দিকে চোখ পড়েছে, তখনই দেখেছি দু–একটি ফুল আছে। পরে জেনেছি, লেখক শেখর রায় এই গাছ দিনাজপুর থেকে তাঁকে এনে দিয়েছিলেন। 

উদ্ভিদের সন্ধানে বিভিন্ন বন–বাগানে ঘুরতে ঘুরতে গত কয়েক বছরে ফুলটি অনেকবার চোখে পড়েছে। প্রসঙ্গত, খুলনার পাইকগাছা উপজেলার একটি বাগান, বান্দরবানের লামায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের কথা বলা যায়। পাতা, ফুলের গড়ন ও দীর্ঘকালীন প্রস্ফুটন প্রাচুর্যের কারণে যেকোনো বাগানের জন্য ফুলটি আদর্শ। এ কারণে ইদানীং অনেক বাগানেই ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণিজ্ঞানকোষ গ্রন্থে এই ফুলের নাম চিমাইন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক নাম Thunbergia fragrans। সেখানে বলা হয়েছে, একসময় ফুলটি বিভিন্ন বাগানে চাষ করা হতো। এখন প্রাকৃতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

চিমাইনের ইংরেজি নাম সুইট ক্লক ভাইন বা অ্যাঞ্জেল উইংগস। সরু, বীরুত্সদৃশ বা লতানো, চতুষ্কোণী, রোমশ উদ্ভিদ। পাতা সবৃন্তক। পত্রবৃন্ত সরু, আড়াই থেকে ৪ সেন্টিমিটার লম্বা। পত্রফলক উপবৃত্তাকার থেকে ডিম্বাকৃতি, ৪ থেকে ৮ সেন্টিমিটার, অখণ্ড, তাম্বূলাকার। ফুল সাদা, ৪ থেকে ৬ সেন্টিমিটার লম্বা, কাক্ষিক, একক বা দুটি একত্রে, প্রতিটি ৩ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বা, শক্ত বৃতির ওপরে অবস্থিত। মঞ্জরিপত্র বড়, ডিম্বাকৃতি ১৫ থেকে ২০ মিলিমিটার লম্বা ও একটি মধ্যশিরাযুক্ত। বৃতি ছোট, ২ থেকে ৬ মিলিমিটার লম্বা ও পেয়ালাকৃতি। দলনল ধুতুরার মতো, ২ থেকে আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, দলফলক তির্যক, খণ্ড ৫টি, অর্ধসমান, নল প্রায় দলফলকের মতো লম্বা, গোলাকৃতি, গন্ধহীন। পুংকেশর ৪টি, জোড়ায় স্থাপিত, পরাগধানী দীর্ঘায়ত ও ওপরে সামান্য চঞ্চু আকৃতি। ফুল ও ফলের মৌসুম মার্চ থেকে ডিসেম্বর, বেশি ফোটে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

সেইজ রোজ

হলুদ রঙের ফুলটি বিভিন্ন বাগানে আলংকারিক হিসেবে চাষ করতে দেখেছি। বিক্ষিপ্তভাবে দু–এক জায়গায় দেখতে পাওয়ায় ততটা মনোযোগ দিয়ে দেখা হয়নি। কয়েক দিন আগে ফুলটি আবার দেখার সুযোগ হলো। ছবি তুলতে গিয়ে পাতা দেখে মনে হলো গাছটি পাটগোত্রীয় কি না! গাছটি আমাদের হারিয়ে যাওয়া সেই লিয়্যুইয়া এন্ডোপোগন না তো? যা ছিল পাটগোত্রীয়। শ্যামলী নিসর্গ গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া পাটগোত্রীয় প্রায় এমন একটি গাছের কথা উল্লেখ করেছেন। সেই গাছ আবার যদি ফিরে আসে! বইপুস্তক দেখে গাছটির পরিচয় শনাক্ত করি। নাহ্, এ যে অন্য গাছ। বৈজ্ঞানিক নাম Turnera ulmifolia। ইংরেজি নাম সেইজ রোজ বা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হোলি। স্থানীয় কোনো নাম পাওয়া গেল না।

রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বাড়িতে ফুটেছে টারনেরা বা সেইজ রোজ

টারনেরা বা সেইজ রোজ ছোট ধরনের গুল্মশ্রেণির গাছ। ওপরের দিকে অধিকাংশ শাখান্বিত, কিছুটা রোমশ। পাতা সরল, উপপত্রবহির্মুখী, একান্তর, ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, বল্লমাকার, অপরিণত পাতা রোমশ, পরিণত পাতা রোমহীন, খাটো বৃন্তক, কিনারা দাঁতের মতো, অসমান। ফুল উভলিঙ্গ, একক, কাক্ষিক, ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা, মঞ্জরিদণ্ড পত্রবৃন্তলগ্ন। ফুলের পাপড়িসংখ্যা ৫, হলুদ, সাড়ে ৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পুংকেশর ৫টি, সংযুক্ত অংশ থেকে প্রায় ১৮ মিলিমিটার লম্বা, পুংদণ্ড সরু, দৈর্ঘ্যে সমান, পরাগধানী প্রায় ৪ মিলিমিটার লম্বা, দ্বিকোষী, পৃষ্ঠলগ্ন, সামান্য লম্বা শীর্ষযুক্ত আয়তাকার ও বাঁকানো। ফল প্রায় ৮ মিলিমিটার লম্বা, আয়তাকার, তাতে অনেক বীজ। ফুলের মৌসুম প্রায় বর্ষব্যাপ্ত। তবে প্রধান মৌসুম শীতকাল।


মোকারম হোসেন, প্রকৃতি পরিবেশবিষয়ক লেখক