বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরগুলোর একটি ঢাকা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের সূচক অনুযায়ী, শহরটির বাতাস বছরের বেশির ভাগ দিনই অস্বাস্থ্যকর থাকে। কখনো কখনো পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে দুর্যোগপূর্ণ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ঢাকায় এত দূষণ কেন, এর প্রভাব কী, সমাধানেরই–বা উপায় কী—এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। বিশ্ববিদ্যালয়টির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) চেয়ারম্যান তিনি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাহমিদা আক্তার।
প্রায়ই আমরা ঢাকার বাতাসে দূষণ বেশি দেখতে পাচ্ছি। ফেব্রুয়ারি মাসে আইকিউএয়ারের সূচকে পরপর বেশ কয়েক দিনই ঢাকার বাতাসে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ মাত্রার দূষণ দেখা গেছে। মাঝে বৃষ্টি হলো, বৃষ্টির পরও পরিস্থিতির বদল ঘটেনি। কেন এমনটা হচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন?
কামরুজ্জামান মজুমদার: দেখুন, আমাদের যে ভূতাত্ত্বিক (জিওগ্রাফিক্যাল) ও আবহাওয়া পরিস্থিতি(মেটিওরোলজিক্যাল), তাতে আমাদের এখানে প্রতিবছরের শুষ্ক মৌসুমগুলোয় বায়ুদূষণ বেশি অনুভূত হয়। শব্দটি ‘অনুভূত’ বলছি এ কারণে, দূষণের যে উৎসগুলো আছে, সেগুলো সব সময়ই কমবেশি সক্রিয় থাকে। কিন্তু প্রাকৃতিক, কারণে; অর্থাৎ বৃষ্টি হলে কিছুটা দূষণ ধুয়ে যায় বা কমে যায়। যেমন জানুয়ারি মাসে সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয় এবং ওই মাসে বেশি দূষণ অনুভূত হয়। আবার জুলাই মাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এবং এ কারণে ওই মাসে আমাদের দেশে সবচেয়ে কম দূষণ অনুভূত হয়। এর মানে এই নয় যে জানুয়ারি মাসে আমাদের যানবাহন বেশি চলে কিংবা জুলাই মাসে যানবাহন কম চলে বা শিল্পকারখানা জুলাই মাসে বন্ধ হয়ে যায়। শুধু বিশেষ ক্ষেত্রে ইটভাটা বন্ধ হওয়া ছাড়া আমাদের বাকি কার্যক্রম সারা বছর ধরে চলতে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা অনেকটা প্রকৃতি বা বৃষ্টিনির্ভর। ঢাকায় বায়ুদূষণের জানা উৎসগুলোর মধ্যে আমরা বলতে পারি, ঢাকার চারপাশে প্রায় ১ হাজার ২৫০টি ইটভাটা আছে। এগুলো থেকে বায়ুদূষণ হচ্ছে। ঢাকায় প্রায় ১৫ লাখ যানবাহনের এক-তৃতীয়াংশ ফিটনেসবিহীনভাবে চলাচল করছে। আবার ফিটনেসবিহীন যানবাহনের দুই–তৃতীয়াংশই গণপরিবহন। এগুলো থেকে অনেক দূষণ হচ্ছে। ঢাকায় মেগা প্রকল্প থেকে ব্যক্তিপর্যায়ের ছোট প্রকল্প পর্যন্ত যে নির্মাণকাজগুলো হচ্ছে, সেখানে নির্মাণবিধি ভঙ্গ করা হচ্ছে। নির্মাণকাজের দীর্ঘসূত্রতা, নির্মাণসামগ্রী দীর্ঘদিন ফেলে রাখা—এসব কারণেও বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। এগুলো সমন্বিতভাবে ঢাকার বাতাসকে দূষিত করে তোলে।
চলতি মাসে দূষণের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা কি স্বাভাবিক? আগের রেকর্ডগুলো কী বলছে?
কামরুজ্জামান মজুমদার: ঢাকার গত আট বছরের বায়ুর মানসূচক বা একিউআইয়ের তথ্য-উপাত্ত (বাংলাদেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস থেকে পাওয়া) বিশ্লেষণ করেছে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাওয়া যায়, ২০১৬-২৪ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ আট বছরে এবারের ফেব্রুয়ারি মাসটি তৃতীয় সর্বোচ্চ বায়ুদূষণের মাস। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এর চেয়ে আরও ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি বায়ুদূষণ ছিল। আর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এর চেয়ে অল্প একটু বেশি (২.২%) বায়ুদূষণ ছিল। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বায়ুর মানসূচক ২২৬, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বায়ুর মানসূচক ২৩১ আর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় বায়ুর মানসূচক ছিল ২৩৬। গত সাত বছরে ফেব্রুয়ারি মাস, অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় যে বায়ুর মান, সে তুলনায় ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে (২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাব) ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বায়ুদূষণ বেড়েছে।
আরেকটি মজার বিষয় হলো, ২০২৩ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের তুলনায় এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় দূষণ কম অনুভূত হয়েছে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর নিম্নমুখী বায়ুদূষণের প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তবে ফেব্রুয়ারি মাসে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
ঢাকার কোন কোন স্থানে দূষণের মাত্রা বেশি? ঢাকার ভেতরেই কোনো এলাকায় দূষণ কম, কোনো এলাকায় দূষণ বেশি—এই তারতম্যের কারণ কী?
কামরুজ্জামান মজুমদার: ঢাকা শহরের যেখানে নির্মাণকাজ বেশি হচ্ছে, সেখানেই দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। আজ কোনো এলাকায় নির্মাণকাজ শুরু হলে সেখানে আজ থেকেই দূষণ বেড়ে যাবে। কাল সেখানে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেলে আবার দূষণ কমে যাচ্ছে। তাই ঢাকা শহরে বায়ুদূষণের হটস্পট নির্ধারণ করা খুব জটিল কাজ। ঢাকা শহরের শব্দদূষণের ক্ষেত্রে হটস্পট নির্ধারণ করা যায়। বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে আমরা গত ১০ বছর লক্ষ করছি, যখন যে এলাকায় নির্মাণকাজ বেশি হয়, সেখানে বায়ুদূষণ বেশি। এই মুহূর্তে হাতিরঝিল এলাকায় এফডিসির সামনে, অর্থাৎ যে অংশে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পের নির্মাণকাজ চলছে, সেখানে বায়ুদূষণ বেশি। ১০০ ফিটের পুরো এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ অঞ্চলে দূষণ বেশি। সিদ্ধেশ্বরীর যেখানে নির্মাণকাজ চলছে, সেখানে দূষণ বেশি। পুরো মোহাম্মদপুরে ২০টির মতো রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখা হয়েছে, সেখানে এখন দূষণ বেশি।
আবার যেখানে জলাধার ও সবুজের উপস্থিতি বেশি, সেখানে বায়ুদূষণ কম। যেমন আপনি যদি পিলখানায় যান, দেখবেন সেখানে বায়ুদূষণ কম, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে গেলে দেখবেন সেখানে বায়ুদূষণ কম, রমনা পার্কের ভেতরে দেখেন সেখানে বায়ুদূষণ কম, আপনি যদি বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভেতরে দেখেন, সেখানে বায়ুদূষণ কম।
দূষণের ক্ষেত্রে আন্তসীমান্ত বায়ুপ্রবাহের একটা প্রভাব আছে বলা হয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, সীমান্তের বাইরে থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন বস্তুকণা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে উড়ে আসার কারণে ঢাকার বায়ু আরও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে। এটা কীভাবে সমাধান করা যায়?
কামরুজ্জামান মজুমদার: ঢাকায় বায়ুদূষণের যে উৎসগুলো আছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, নির্মাণকাজ বা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে, শিল্পকারখানা বা ইটভাটা থেকে ২৯ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে, আন্তদেশীয় বায়ুপ্রবাহের কারণে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে, গৃহস্থালি ও রান্নার কাজ থেকে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ দূষণ হয়ে থাকে এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণে প্রায় ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এ ছয় উৎস থেকে মূলত বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। আন্তসীমান্ত বায়ুদূষণ সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে, অর্থাৎ জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে হয়ে থাকে। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, পাকিস্তান, নেপাল আবার কখনো আরও দূর থেকে, অর্থাৎ তিব্বতের দিক থেকে দূষিত বায়ু আসতে পারে। এর সমাধানে আসলে সরাসরি কোনো উপায় নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে, যেন তারা তাদের বায়ুদূষণ কমাতে ব্যবস্থা নেয়। এ ছাড়া সহজে কোনো সমাধান বের করা কঠিন। তারাও তো তাদের দেশের দূষণ কমানোর চেষ্টা করছে। আর বাতাস তো সীমানা মানে না।
দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে?
কামরুজ্জামান মজুমদার: ঢাকার বাইরের বায়ুদূষণের উৎসগুলোও ঢাকার মতোই। যেখানে নির্মাণকাজের আধিক্য বেশি কিংবা ইটের ভাটা আছে, শিল্পকারখানা আছে, সেখানে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। আর বায়ুদূষণের যে প্রভাব, তা পুরো দেশে কমবেশি একই রকম। বয়স্ক মানুষ, অন্তঃসত্ত্বা, শ্বাসকষ্টের রোগীদের ওপর বেশি প্রভাব পড়ছে। বায়ুদূষণের কারণে শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হচ্ছে। প্রাণ–প্রকৃতির ওপর প্রভাব পড়ছে। পরাগায়ন ব্যাহত হচ্ছে। কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
বায়ুদূষণ রোধে সরকারিভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো কি পর্যাপ্ত বলে মনে করেন?
কামরুজ্জামান মজুমদার: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা করা হয়েছে ২০২২ সালে। বিধিমালা অনুযায়ী, এটি ভালো বিধিমালা। পরিবেশ অধিদপ্তরও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ নির্দেশিকা তৈরি করেছে। যে বিধিমালাগুলো রয়েছে, তাতে বলা যায়, আইনকানুনের দিক থেকে যথেষ্ট পর্যাপ্ততা আছে।
যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়ার কথা, সেগুলো কি ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে?
কামরুজ্জামান মজুমদার: বিধিমালা কার্যকরের বিষয়ে আমি বলব, এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যেমন পুলিশ বিভাগকে আমরা পরিবেশসংক্রান্ত আইনকে ভালোভাবে পরিচিত করাতে পারিনি। যেমন কোনো গাড়ি যদি কালো ধোঁয়া তৈরি করে পুলিশের সামনে দিয়ে চলে যায়, পুলিশ এটিকে কোনোভাবে আইনের আওতায় আনতে পারে না। কারণ, তাদের ম্যাজিস্ট্রেটের সহযোগিতা নিতে হয় অথবা মেশিন দিয়ে দূষণ পরিমাপ করতে হয়। কালো ধোঁয়া উৎপাদনকারী এবং ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলো ধরতে পুলিশের ক্ষমতা থাকতে হবে। তাদের এ ব্যাপারে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আবার নির্মাণকাজ থেকে যে বায়ুদূষণ হয়, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সিটি করপোরেশন। কারণ, এ ক্ষেত্রে কোন এলাকায় কত দিন নির্মাণকাজ চলবে, সিটি করপোরেশন থেকে সে অনুমোদন নিতে হয়। আবার বর্জ্য পোড়ানোর বিষয়টিও সিটি করপোরেশনকেই তদারকি করতে হবে। ফিটনেসবিহীন যে ইটের ভাটাগুলো আছে, সেগুলোর ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
সামগ্রিকভাবে বায়ুদূষণ মোকাবিলায় আপনার সুপারিশ কী?
কামরুজ্জামান মজুমদার: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। এটা যে শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে, তা নয়; যারাই নির্মাণকাজ করবে, যে মন্ত্রণালয়ের নির্মাণকাজ চলবে, তখন যেন তাদের কোনো কর্মকাণ্ডের কারণে দূষণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে ওই মন্ত্রণালয়কেই ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে সব মন্ত্রণালয়কে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।