কিছুক্ষণ আগে বৃষ্টিটা থেমেছে। আকাশে তখনো জমাট মেঘ, দমকা বাতাসে দুলছে সুন্দরবনের বৃক্ষলতা। পিচ্ছিল এঁটেল মাটি, বর্ষার জল নামছে ঝরঝর করে, সরুসরু নালা আর খাঁড়ি বেয়ে নিচের খালে ও নদীতে। ভেজা ভেজা গন্ধ, কাদার দাপাদাপি, তারপরও ছাতা মাথায় টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে খালপাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছি এক জায়গায় যাব বলে।
হঠাৎ নজরে পড়ল নিচু, জলাভূমির কোল ঘেঁষে বিশাল বিশাল সুন্দরবনের গাছ হারগোজার ঝোপ, তার পেছনে খাল, খালের ওপারে ছইলাবন। ছইলাগাছেও ফুল ফুটেছে। আছে কাঁকড়া, বাইন, জিরবট, পানবট, হুদো, বাটুলগোটার গাছও। বর্ষাকাল শেষ হয়ে শরৎকাল এসেছে।
দেখলাম হারগোজাগাছে ফুল ফুটে রয়েছে। এর আগে অনেকবারই দেখেছি হরগোজা ফুলকে, চূড়ার মতো ধীরে ধীরে ওপর দিকে সরু হয়ে উঠে গেছে পুষ্পমঞ্জরির ফুল-কুঁড়ি। নিচের দিকে ফুটছে নীল বেগুনি দুই পাপড়ির ফুল। শরতের আকাশে নীল রং থাকার কথা। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনে আকাশের চেহারা বদলে গেছে। আকাশটা নীল নেই, নেই সাদা মেঘের ভেলা। আকাশজুড়ে কেবলই ছাইরঙা মেঘের দাপাদাপি, মাঝেমধ্যে বৃষ্টির উৎপাত। আকাশের সেই নীল রং চুরি করে তাই বুঝি হারগোজা ফুলেরা এমন সেজেছে!
ভালো লেগেছে ফুলগুলোকে দূর থেকে দেখতে, ঝোপের মধ্যে ফুটে থাকা অনেক পুষ্পমঞ্জরিতে একসঙ্গে অনেক ফুল। কিন্তু আজ এই একটি ফুলকেই এত বেশি সুন্দর লাগছে কেন? একই তো ফুল। ভালো লাগাটা আসলে অনুভবের, ভাষার নয়। আজ হয়তো মনটা একটু বেশি ভালো, বৃষ্টিভেজা প্রকৃতিতে মনটা একটু নরম হয়ে আছে। তারপরও মনে হলো, আজ আসলেই হরগোজা যেন নীলাম্বরী শাড়ি পরা বৃষ্টিভেজা তরুণী। কোনো দিন এ ফুলকে এত বড় আর সুন্দর হয়ে ফুটতে দেখিনি, এত সতেজ রূপও দেখিনি।
ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর মুখে লেগে থাকা বৃষ্টিকণাগুলোকে—শুদ্ধ পবিত্র আর সুন্দরের যেন এক অতুলনীয় প্রতীক। আকাশ মেঘে ঢেকেছে, সব নীল ঢাকা পড়েছে মেঘে। কিন্তু মনে হলো আকাশের সবটুকু নীল যেন আজ হারগোজার ফুলে।
খুলনার বাণীশান্তা গ্রামের বনের প্রান্তে নিচু জায়গায় ঘন ঝোপ, হলদে সবুজ কিনারায় ঢেউ খেলানো করাতের মতো খাঁজ কাটা পাতা তীক্ষ্ণèকাঁটায় ভরা। এর মধ্যে ফুটে আছে একটি ফুল।
দুটি পাপড়ির নীল রঙে সামান্য বেগুনি আভার ঝিলিক, পাপড়ির নিচের অংশ হলুদাভ সাদা, পাপড়ির বুকের মধ্যেই ঠাঁই করে নিয়েছে জননাঙ্গগুলো। ছবি তোলার পরও ওকে দেখলাম কয়েকবার। মনে হলো, প্রাচুর্যে সুখ নেই, এত ফুল একসঙ্গে কতবারই তো দেখেছি। কিন্তু এই একটি ফুলই যেন আজ অন্য রকম লাগল, অন্য রকম এক ভালো লাগার সাক্ষী হয়ে রইল হরগোজা বা হারগোজা ওরফে হুরকুচ কাঁটা ফুল।
হারগোজার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Acanthus ilicifolius, পরিবার অ্যাকান্থেসি। হারগোজাগাছ ঘন ঝোপ করে জন্মে খাল-নদীর চরে জলসংলগ্ন হয়ে। গাছ ভীষণ শক্ত, কণ্টকময়। পাতার কিনারা তীক্ষ্ণèকাঁটাময়, আঁকাবাঁকা খাঁজকাটা। পাতা সবুজ থেকে হালকা সবুজ, চকচকে। ফুলের দুই দিকে প্রজাপতির মতো দুটি পাপড়ি থাকে ডানা মেলে, পাপড়ির ওপরের দিকের রং নীলাভ, মাঝখানে প্রদীপের শিখার মতো গাঢ় নীল বেগুনি আর তার দুই পাশে হালকা হলুদাভ রং।
অপূর্ব সে রঙের বিন্যাস। পুংকেশর চারটি দেখতে হুবহু টুথব্রাশের মতো, তার মধ্যে রয়েছে গুঁড়া গুঁড়া হলুদ পরাগরেণু। চারটি পুংকেশরই একটি স্ত্রীকেশরকে ঘিরে রেখেছে। স্ত্রীকেশর পুংকেশরের চেয়ে কিছুটা লম্বা ও সাদা রঙের, বৃতি সবুজাভ হলদে। পাপড়ি বেশ শক্ত ও পুরু চামড়ার মতো।
ফুল ফোটে ডালের মাথায়, ছড়াতে। ফল চকচকে সবুজ, উপবৃত্তাকার ক্যাপসুলের মতো। স্থানীয় লোকদের বিশ্বাস, হারগোজার ফল ও পাতা দিয়ে সাপে কাটার চিকিৎসা করা যায়। জালের মতো বিছানো হারগোজার শিকড় মাটির ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক