বিখ্যাত ব্রিটিশ পাখি গবেষক গ্যারি অলপোর্ট বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকায় বসবাস করছেন। ব্যস্ত কংক্রিটের এ নগরে তাঁর পাখি দেখার জায়গা নেই বললেই চলে। কিন্তু গ্যারিকে পাখির কাছ থেকে দূরে রাখা একেবারেই অসম্ভব। তিনি জানেন, শরতে দিনের আকাশ যেমন সুন্দর, রাতের আকাশও অভিনব। হরেক রকমের সুরে ভরা।
বিশেষ করে রাত বাড়তে থাকলে আকাশে সুর আর ছন্দ একেবারেই ভিন্ন রকম হয়। এ সময় গাড়ির হর্ন বা মানুষের কোলাহল থাকে না বললেই চলে। গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাত দুইটা থেকে ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত আকাশে পাখির ডাক রেকর্ড করতে তিনি গুলশানের নিজ বাসার বাড়ির ছাদে উঠেছিলেন। পরদিন সেই সুর শুনে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অসাধারণ সব সুর-লয়। প্রতিটি পাখির উড়ে যাওয়ার শব্দ ও কণ্ঠ একেবারেই আলাদা।
গ্যারি প্রতিটি পাখির ডাক আলাদা করে দেখলেন, প্রায় ৬৫ রকমের ভিন্ন ভিন্ন আওয়াজ। এর মধ্যে ২০টি ডাক তিনি শনাক্ত করতে পারলেন। একটি নিশি বকের ডাক ছাড়া বাকি সবই পরিযায়ী পাখির সুর। বেশির ভাগই পরিযায়ী বন, হলদে আর সিট্রিন খঞ্জনের আওয়াজ। এ ছাড়া আছে একটি সৈকত পাখি আর একটি ঘাস পাখির ডাক। এ দুই প্রজাতিও পরিযায়ী। এই পাখিগুলোর প্রায় সব প্রজাতিই এ দেশে আসে রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, চীন আর তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে।
শীত আসতে এখনো বাকি, তবে পরিযায়ী পাখিরা এখনই আসতে শুরু করেছে। পুরো অক্টোবর আর নভেম্বর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের আকাশ মুখর থাকবে পরিযায়ী পাখির ডাকে। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখন এই পরিযায়ী পাখিগুলোর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণই বেশি পছন্দ। সাধারণ মানুষের এই পাখিগুলোর গল্প জানা থাকলে হয়তো শরৎটা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠত।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ পরিযায়ন করা দুটি সৈকত পাখির জাত হলো কালালেজ জৌরালি ও দাগিলেজ জৌরালি। এ দেশে প্রতিবছর শীতে পাঁচ হাজারের মতো কালালেজ জৌরালি দেখা যায়। তবে দাগিলেজ জৌরালির দেখা মেলে কালেভদ্রে। দুটি পাখিরই রাশিয়ায় তাদের প্রজননভূমি থেকে টানা প্রায় ৯ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে আমাদের উপকূলে পৌঁছানোর রেকর্ড আছে। এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে একটি পাখি কতবার আওয়াজ করে, তার ঠিক গবেষণা নেই। তবে এটা অনুমান করা যায়, কমপক্ষে ২০ হাজারবার ডাক দেয় বা আওয়াজ করে থাকতে পারে। এ দেশে প্রতি শীতে বিভিন্ন প্রজাতির লাখখানেক সৈকত পাখি আসে। বেশির ভাগ পাখিই আসে অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসে। তাহলে বুঝতেই পারা যায়, এক সৈকত পাখির আওয়াজই শরতের আকাশটা কতখানি মুখর করে তোলে।
হাঁস পাখির প্রায় ৩৩টি প্রজাতি আমাদের দেশে দেখা যায়। এর মধ্যে দুটি প্রজাতি আমাদের আবাসিক হাঁস পাখি। বালিহাঁস আর দেশি মেটে হাঁস। এ ছাড়া দেখা মেলে ছোট সরালির। এ প্রজাতিগুলো সারা বছরই এ দেশে দেখা যায়। অন্যান্য প্রজাতির কয়েক লাখ হাঁস পাখি আমাদের দেশে খাবারের সন্ধানে আসে শীতে। শরৎজুড়ে এগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে স্থিত হয়। এই হাঁস পাখির কণ্ঠের আওয়াজ সৈকত পাখির চেয়ে অনেক জোরালো হয়। দেশের যেকোনো প্রান্তে রাতের বেলায় কান পাতলে এখন এসব পাখির সুর–ছন্দ কানে ভেসে আসবে।
দাগি ও মেটে রাজহাঁস এ দেশের সবচেয়ে বড় পরিযায়ী হাঁস পাখি। সবচেয়ে উঁচু পথে পরিযায়ন করার বিশ্ব রেকর্ড এগুলোর আছে। এমনকি হিমালয়ের সবচেয়ে উঁচু পর্বত এভারেস্টের ওপর দিয়েও এ জাতের রাজহাঁসগুলো পরিযায়ন করে। এ দেশের দুবারের এভারেস্টজয়ী বন্ধু এম এ মুহিত এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার সময় তাঁর তাঁবুর ভেতর থেকে বেশ কয়েক জাতের হাঁস পাখির আওয়াজ শুনেছেন বলে আমাকে গল্প শুনিয়েছেন। তার বেশির ভাগই ছিল খয়রা চখাচখি।
বাংলাদেশে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা তিন শতাধিক। এ দেশের জলাশয়গুলো শীতজুড়ে লাখ লাখ পরিযায়ী পাখির বিচরণে মুখর থাকে। শরতের পুরোটা, এমনকি শীতের মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিযায়ী পাখি এ দেশে আসে।
আজ বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। বাড়ির উঠানে কিংবা ছাদে গিয়ে শরতের এ রাতে পরিযায়ী পাখিদের ডাক উপভোগ করুন।