প্রাকৃতিক দুর্যোগে গত ২০ বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারের গড়ে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৪৯১ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। গঙ্গা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা অঞ্চলের শরীয়তপুরে এই ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩০ টাকা। আর বরেন্দ্র অঞ্চলে গড়ে ৩৩ হাজার ৭৬৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
গবেষণা করে এমন ফলাফল উপস্থাপন করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)। গবেষণায় সংস্থাটি আঞ্চলিক তিনটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) শরীয়তপুর এলাকায় শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি (এসডিএস), রাজশাহীতে মাসাউস এবং সাতক্ষীরায় বাদাবন সংঘের সহায়তা নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ওই তিন অঞ্চলের ২০০ করে ৬০০টি পরিবারের ওপর গবেষণাটি হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান মো. শামসুদ্দোহা এই ফলাফল তুলে ধরেন।
ফলাফল তুলে ধরে সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুদ্দোহা বলেন, দক্ষিণাঞ্চলে আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ কৃষিজমি ও বসতভিটা হারানো। এর কারণে ৫০ দশমিক ৩ ভাগ পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বসতবাড়ির ক্ষয়ক্ষতির কারণে ২৯ দশমিক ৭ ভাগ পরিবার, গৃহপালিত পশুপাখির কারণে ৮ দশমিক ৪ ভাগ পরিবার, গৃহস্থালি সামগ্রীর ক্ষয়ক্ষতির কারণে ৫ দশমিক ৮ ভাগ এবং মাছ ধরার সরঞ্জাম, গাছপালা, রান্নাঘর ও শৌচাগারের ক্ষতির কারণে ৩ দশমিক ৪ ভাগ।
ওই এলাকার শতভাগ মানুষ স্বাস্থ্যসংকটে ভোগার পাশাপাশি প্রাণহানি বেড়েছে ২ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে। আর ৩২ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, ১৪ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
অন্যদিকে শুধু নদীভাঙনেই ২০ বছরে গড়ে ২৪ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শরীয়তপুর অঞ্চলের একেকটি পরিবারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে গবাদি পশুপাখির মৃত্যু ও অন্য ক্ষয়ক্ষতি হিসাবে গত ২০ বছরের ওই এলাকায় প্রতি পরিবারে আর্থিক পরিমাণ গড়ে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৩৩০ টাকা।
অঞ্চলটির ১০ দশমিক ৫ ভাগ মানুষের কাজের (দিনমজুরি) সুযোগ কমে গেছে। স্থানান্তরের কারণে পরিচয়–সংকটে ভুগছেন ৬২ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ। উৎসব ও মনের আনন্দ কমে গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষণায় অংশ নেওয়া এখানকার ৭৩ ভাগ মানুষ।
নদীভাঙনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট অভাবের কারণে উত্তরদাতা ৩৫ ভাগের সন্তান বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ২৬ ভাগ পরিবার শিশুসন্তানদের কাজে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ ভাগের সন্তানেরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত।
বরেন্দ্র অঞ্চলের ৯৩ ভাগ পরিবার খাওয়ার পানির সংকটে ভুগছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। অতিরিক্ত গরমের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ৩৮ দশমিক ৫ ভাগ মানুষের শ্রমঘণ্টা কমেছে। বিভিন্ন মেয়াদে কর্মহীন হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ। আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ৯৯ দশমিক ৫ ভাগ পরিবারে রোগব্যাধি বেড়েছে বলে গবেষণায় পাওয়া গেছে।
গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন শেষে সিপিআরডির নির্বাহী প্রধান শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ভুক্তভোগীদের খাদ্য, পানি, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষাপ্রাপ্তির মৌলিক অধিকার এবং মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশে সফরে আসা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফ্রাই জাতিসংঘে এ বিষয়টি উপস্থাপন করবেন বলেও তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে মানবাধিকারের বিপর্যয় হচ্ছে, এ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। এই গবেষণার ফলাফল তার আরও একটি প্রমাণ। মানুষের অধিকার হরণ নিয়ে আরও গবেষণা করে প্রতিবেদনগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী নিখিল চন্দ্র ভদ্র বলেন, গণমাধ্যমে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের মুখ থেকে তাদের বঞ্চনা এবং অধিকার হরণের গল্প শোনা যায়। কিন্তু দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন এসডিএসের নির্বাহী পরিচালক রাবেয়া বেগম, মাসাউসের নির্বাহী পরিচালক ম্যারিনা মূর্মু, বাদাবন সংঘের নির্বাহী পরিচালক লিপি রহমান প্রমুখ। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, অংশীজনেরাও তাঁদের মতামত দেন।