মোখা, হামুন এবং তারপর মিধিলি। এ বছর তিন তিনটি ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ল বাংলাদেশে। এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার বিষয়টি জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের কারও কারও মতে অস্বাভাবিক। কেউ কেউ মনে করেন, এতে খুব অস্বাভাবিকতা নেই। বর্ষা ঋতুর শেষে কার্তিক মাসে একটানা কয়েক দিন বৃষ্টি সাধারণত হয়। এরপরই শীত জাঁকিয়ে বসে। এটা বরাবরই হয়ে আসছে।
আবহাওয়াবিদেরা অবশ্য বলছেন, এবার ‘এল নিনো’ জলবায়ু পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। তাতে প্রকৃতি যে এলোমেলো আচরণ করবে, তা অনেকটাই ধরে নেওয়া হয়। এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় এই এলোমেলো আচরণের নজির। এর সঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সম্পর্ক আছে বলেও মনে করেন তাঁরা।
ক্ষয়ক্ষতির বিচারে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সবচেয়ে বড়। এর পর থেকে এবারের ‘মিধিলি’ নিয়ে ছোট–বড় মিলিয়ে ২০টির মতো ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। ‘ভোলা সাইক্লোন’ নামে অধিক পরিচিত ১৯৭০–এর ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৯১–এর ঘূর্ণিঝড়টিতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তীব্রতার মাত্রায় ছিল ২০০৭ সালের সিডর। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলাও ছিল বড় আকারের। এরপর অবশ্য খুব বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. বজলুর রশীদ প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আইলার পর খুব বড় মাত্রার ঘূর্ণিঝড় আসেনি। এর পর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে, তবে কমেছে তীব্রতা।’
চলতি বছরের ১৪ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। এই ঘূর্ণিঝড় ওই দিন সন্ধ্যা ছয়টায় টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশ উপকূল পেরিয়ে যায়। এটি দুর্বল হয়ে মিয়ানমারের সিত্তওয়েতে স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়। পরে আরও দুর্বল হয়ে যায়। মোখার তীব্রতা বেশি হবে ধারণায়, কক্সবাজার বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছিল।
গত ২৪ অক্টোবর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। এতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে প্রাণহানি এবং বসতবাড়ি ও ফসলও নষ্ট হয়। এরপর আজ শুক্রবার আঘাত হানল ‘মিধিলি।’ এ নাম মালদ্বীপের দেওয়া। এ ঝড় খুব বড় মাত্রার হবে না বলে আগে থেকে ধারণা করছিলেন আবহাওয়াবিদেরা। আবহাওয়া অফিস জানাচ্ছে, পটুয়াখালীতে বেলা তিনটার দিকে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০২ কিলোমিটার।
অক্টোবর ও নভেম্বর ‘ঘূর্ণিঝড়প্রবণ’ মাস হিসেবে পরিচিত। দেশে সাধারণত মৌসুমি বায়ু আসার আগে এবং চলে যাওয়ার পর ঘূর্ণিঝড় হয়। মৌসুমি বায়ু আসার আগে মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হয়। আবার চলে যাওয়ার পর অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ঘূর্ণিঝড় হয়ে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ৬২০টি ঘূর্ণিঝড় ও অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। আর নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে ৯৪১টি। ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অক্টোবর মাসে হয়েছে ২৫৫টি, নভেম্বরে ২১৯ ও ডিসেম্বরে ১০৫টি। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মধ্যে অক্টোবরে ৪২টি, নভেম্বরে ৭৪ ও ডিসেম্বরে ২৮টি হয়েছে।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ১৮৯১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অক্টোবর মাসে সাগরে এ পর্যন্ত নিম্নচাপ হয়েছে ১২৯টি, নভেম্বরে ৭১ ও ডিসেম্বরে ৪৫টি।
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে লঘুচাপ, সেখান থেকে নিম্নচাপ একে স্বাভাবিক বলেই মনে করেন দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি বলছিলেন, আশ্বিনে আইতান কার্তিকের কাইতান নামে বাংলা বদ্বীপে ঝড়বৃষ্টি দিনপঞ্জি মেনেই চলে। কার্তিকের অমাবস্যা-পূর্ণিমায় ঝড়বৃষ্টি কোনো নতুন কথা নয়। বর্ষা ঋতু শেষে কার্তিক মাসে একটানা কয়েক দিন বৃষ্টি হয়। এরপরই শীত আসতে শুরু করে জোরেশোরে। কার্তিকের এ বৃষ্টিকেই কাইতান বলে।
এই আইতান ও কাইতানের সঙ্গে যে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার সম্পর্ক আছে, তা এবারের দুটি ঝড় ‘হামুন’ ও ‘মিধিলি’ সংঘটিত হওয়ার সময়ের তুলনা করে বুঝিয়ে দেন গওহার নঈম। তিনি বলেন, ‘হামুন এসেছিল অমাবস্যার আগে আর মিধিলি এল পূর্ণিমার পর। এটা এ সময়ে স্বাভাবিক।
এবার এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে বাংলাদেশে, এটা স্বাভাবিক বলে মনে করেন না বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি বলছিলেন, ‘এর আগে ২০২১ সালে এক বছরে তিনটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। তবে সেগুলোর প্রভাব বাংলাদেশে খুব বেশি পড়েনি। এবার তিনটি ঘূর্ণিঝড়ই বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছে। এটা স্বাভাবিক নয়, ৫০ বছরে এমনটা হয়নি। আমরা এর মধ্যে নেতিবাচক পরিবর্তন দেখছি।’
বিশ্বে চলতি বছর একের পর এক মাস উষ্ণতম হিসেবে রেকর্ড হয়েছে। ইউরোপভিত্তিক জলবায়ুবিষয়ক পর্যবেক্ষক সংস্থা কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের (সি৩এস) এক প্রতিবেদনে বলেছে, চলতি বছরের জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসের পর অক্টোবর মাসটিও ছিল সর্বোচ্চ উষ্ণ মাস। এতে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি ২০২৩ সালটি ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হতে যাচ্ছে।
অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম প্রকৃতির এই ‘নেতিবাচক পরিবর্তনের’ পেছনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক খুঁজেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বাড়ছে, গত ৫০ বছরের হিসাব ধরে এমনটা বলা যায়। এর কারণ আমাদের বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সাগর উত্তপ্ত হচ্ছে। উত্তপ্ত বায়ু ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সহায়ক। আবার এর মধ্যে এবার এল নিনোর বছর। ইতিমধ্যে এ বছর উষ্ণতম বছর হিসেবে গণ্য হয়েছে। তাই ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে।’
পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উষ্ণ থাকে, তখন তাকে এল নিনো বলে। আর এর বিপরীত অবস্থার নাম ‘লা নিনা’, পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলীয় প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা যখন স্বাভাবিকের চেয়ে কম থাকে, তখন তাকে লা নিনা বলা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ বলছিলেন, ‘এল নিনোর সঙ্গে উষ্ণায়ন ও ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যাবৃদ্ধির সম্পর্ক আছে। ফলে আমাদের দেশে এবার ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধিরও সম্পর্ক আছে।’