দেশের অন্তত ১১টি জেলা আকস্মিক বন্যার কবলে পড়েছে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এরই মধ্যে। বন্যার পূর্বাভাস, আগাম বার্তা, এসব নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ শঙ্কর সাহা।
দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল ও উত্তর–পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১১টি জেলা বন্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এ জেলাগুলোয় এবার হঠাৎ বন্যার কারণ কী?
উদয় রায়হান: আমরা দেখেছি, ১৭ ও ১৮ আগস্ট থেকে বঙ্গোপসাগর এবং এর পশ্চিম উপকূলে মৌসুমি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়। এই লঘুচাপ টানা দুই দিন সেখানে অবস্থান করে। ওই সময় দেশের উপকূল এবং দক্ষিণ–পূর্বের পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টিপাত হয়। নদ–নদীর পানি এরপরই বাড়তে থাকে। এরপর এই বৃষ্টি বাড়তে থাকে। ১৯ আগস্ট এটি সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হয়। এরপর এই লঘুচাপ বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এর আগে পূর্বাভাস ছিল, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বিহারের দিকে যাবে। কিন্তু এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে দেশের মধ্যাঞ্চলে থেকে যায়। এটি থাকে ২০ তারিখ পর্যন্ত। সে সময় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। ২০ তারিখ রাতে বড় ধরনের বৃষ্টি হয়। এতেই আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ সময় মৌসুমি লঘুচাপের কারণে সাগরে স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু জোয়ারের সৃষ্টি হয়। এখানে একটি বিষয় বলা যায়, ১৯ তারিখে পূর্ণিমা তিথি ছিল। এর ফলে জোয়ার আরও বেড়ে যায়। এতে নদ–নদীর পানি নিষ্কাশনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তা বাধাগ্রস্ত হয়। এর সম্মিলিত প্রভাবে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরে একটি চরম রূপ লাভ করে।
দেখা গেছে, ওই সব এলাকায় আমাদের যেসব স্টেশন আছে সেগুলোর কোনো কোনোটিতে এ মাসের স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন গুণ বেশি বৃষ্টি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এতেই বোঝা যায়, কতটা বৃষ্টি হয়েছে।
এখানে বলতে হবে, বৃষ্টি হয়েছে আমাদের দক্ষিণ–পূর্ব পুরো অববাহিকাজুড়ে এবং ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে। এটি পাহাড়ি অঞ্চল। ত্রিপুরার এই পানি ঢলের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং বন্যা হয়।
এ মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, এসব অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা হতে পারে। সে অনুযায়ী বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র কি যথাযথভাবে বার্তা দিতে পেরেছিল? একটা অভিযোগ উঠেছে, আপনারা সঠিক সময় বার্তাটা দেননি, এটা কতটুকু ঠিক?
উদয় রায়হান: বন্যার আগাম পূর্বাভাস সঠিক সময়েই দেওয়া হয়েছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে আকস্মিক বন্যা হতে পারে দক্ষিণ–পূর্ব এবং উত্তর–পূর্বাঞ্চলে। এই দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসের যে কমিটি, সেখানে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালকের সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলীও থাকেন। দুই প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগ ও মতৈক্যের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দেওয়া হয়। যেকোনো আকস্মিক বন্যার পূর্বাভাস দুই থেকে তিন দিন আগে দেওয়া সম্ভব হয়। এখানে এবার বড় সমস্যা ছিল মৌসুমি লঘুচাপটি তার অবস্থান বারবার পরিবর্তন করছিল। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের প্রাথমিক অনুমান ছিল, এটা বিহারের দিকে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। এই লঘুচাপজনিত আকস্মিক বন্যা হঠাৎ করেই ঘটে।
এখন আসি আগাম বার্তা দেওয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে। গত ১৬ ও ১৭ তারিখেই আবহাওয়া অধিদপ্তর ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দেয়। আমরাও (বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র) জানিয়ে দিই, উজানের পানি দ্রুত বাড়তে পারে। নদ–নদীগুলোর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করার আগেই এ–সংক্রান্তে সতর্কতা জারি করা হয়, এসব এলাকায় পানি বিপৎসীমা অতিক্রমের আশঙ্কা আছে। এর পরই ঘটনাটি ছিল।
তবে এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, দেশের পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো মডেলভিত্তিক পূর্বাভাসের ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পূর্বাভাস না থাকায় শুধু বৃষ্টিপাতের ওপর ভিত্তি করে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় উপকূলীয় এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি মডেলভিত্তিক পূর্বাভাস ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সেটি এখনো অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
তবে এবারের বৃষ্টি বা বন্যাসংক্রান্ত বার্তা যথাযথ সময়েই দেওয়া হয়েছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখানে আকস্মিক বন্যা হয়, পানি দ্রুত নেমেও যায়। কিন্তু এবার যা হয়েছে, তা মারাত্মক। এবার ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক হয়েছে। বন্যার বিষয়ে প্রাথমিক অনুমানের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
পানিটা এবার এত দিন ধরে থাকছে কেন?
উদয় রায়হান: এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। মৌসুমি লঘুচাপটি কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশের উপকূলে ছিল। টানা তিন থেকে চার দিন বৃষ্টি হয়। এর সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ার বেশি ছিল। এতে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারেনি। এর ফল বন্যা দীর্ঘায়িত করেছিল।
দেখা গেছে যে আমাদের অভিন্ন নদীগুলো এ সময় বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এসব নদীসংক্রান্ত তথ্য কি ভারত যথাযথভাবে দিয়েছে এবার?
উদয় রায়হান: বর্ষাকালে উজানের দেশগুলো এবং অবশ্যই ভারতের সঙ্গেও বিভিন্ন নদীর (অন্তত আটটি) পানি সমতলের তথ্য আদান–প্রদানের প্রক্রিয়া চলমান আছে। বর্ষাকালে ভারতের সঙ্গে থাকা নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের তথ্য দেশটির জল কমিশন আমাদের নিয়মিত দেয়। গোমতী নদীর অমরপুর পয়েন্ট থেকে, মনু নদীর কৈলাশহর পয়েন্টের তথ্য পাই। এবারও এর ব্যতয় হয়নি। এ দুই পয়েন্টই বাংলাদেশের নিকটবর্তী। আর এ দুই নদী আকস্মিক বন্যাপ্রবণ। সে কারণে উজানের ঢল প্রচণ্ড গতিতে নেমে আসে। এখানে সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৮ ঘণ্টা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে এর চেয়ে কম ভ্রমণ সময় থাকে এই ঢলের। এর ফলে এ ধরনের বন্যার মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয়।
এবার তিন থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে ঢল নেমে এসেছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এই আকস্মিক বন্যার তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়। এর মূল কারণ, ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ভারতের ত্রিপুরা পাহাড়ি অঞ্চল আর বাংলাদেশের একেবারে কাছে।
উজানে যে পানি বাড়ছে, সে তথ্য এবার পেয়েছিলাম। অমরপুর (ত্রিপুরা) পয়েন্ট থেকে আমরা ১২ ঘণ্টা আগেই পানি বৃদ্ধির তথ্য পেয়েছিলাম।
আপনাদের তথ্যগুলো আপনারা সরকারের কোন কোন দপ্তরে সাধারণত দেন?
উদয় রায়হান: ভারতের জল কমিশনের তথ্য আমরা পাই। এটা আমাদের বন্যা পূর্বাভাসে সহযোগিতা করে। এসব তথ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, সব জেলা প্রশাসন অফিস, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাঠপর্যায়ের সব অফিস, প্রতিরক্ষার সঙ্গে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী—সবাইকে এসব তথ্য দেওয়া হয়। অনেক বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের উপজেলা প্রশাসন অফিসকেও তথ্য দেওয়া হয়। উন্নয়ন সহযোগী বেসরকারি সংগঠনগুলোকেও (এনজিও) তথ্য দেওয়া হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা জাতীয় কমিটির মাধ্যমে জাতীয় প্রটোকল মেনে ইউনিয়ন পর্যায়েও তথ্য দেওয়া হয়। আমাদের ওয়েবসাইট, গুগল পুশ নোটিফিকেশনের মাধ্যমেও এসব তথ্য দেওয়া হয়।
আপনাদের সঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের যোগাযোগ কী পর্যায়ে হয়?
উদয় রায়হান: যৌথ নদী কমিশনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। আমাদের যেসব আন্তসীমান্ত নদী আছে সেগুলোর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেসব তথ্য দরকার সেগুলো প্রস্তাব আকারে যৌথ নদী কমিশনের কাছে পাঠাই। যৌথ নদী কমিশন ভারতের যেসব প্রতিনিধি আছেন তাঁদের কাছে এসব তথ্য তুলে ধরে। দ্বিপক্ষীয় পানি বা নদীসংক্রান্ত তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থাপনার প্রটোকল মূলত যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। আমরা এর অংশীদার হিসেবে থাকি। আন্তসীমান্ত নদীর তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে যৌথ নদী কমিশনই আমাদের তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা।
ত্রিপুরার ডমরু বাঁধের গেট খুলে দেওয়া নিয়ে কথা উঠেছে। আমাদের দেশের প্রবল বন্যার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, কোনো আগাম সতর্কবার্তা না জানিয়েই সেই গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আগাম তথ্য জানানোর কোনো নিয়ম কি আছে?
উদয় রায়হান: এখন আমরা ভারতের জল কমিশনের কাছে থেকে যেসব তথ্য পাই, তা উজানের নদ–নদীর পানি সমতলের তথ্য। পানির কাঠামোগত তথ্য বা বাঁধ, ব্যারাজ বা অন্য যেকোনো তথ্য আমরা পাই না। এসব তথ্য পাওয়ার জন্য কোনো প্রটোকলও নেই। বাংলাদেশের দিক থেকে প্রস্তাব আছে এ–সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার। কিন্তু ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর কোনো তথ্য আমরা পাই না।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করতে পারি, গত বছরের অক্টোবরে ভারতের সিকিমে তিস্তা নদীর বাঁধ ভেঙে যায়। এতে আশঙ্কা ছিল, বাংলাদেশেও বড় বন্যা তৈরি হতে পারে। সে সময় ভারতের জল কমিশন দ্রুতগতিতে আমাদের সরকারি চ্যানেলেই জানায়। পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যও অনুরোধ করে তারা। এরপর আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিই। এতে ক্ষয়ক্ষতিও রোধ করা যায়। এমন একটি রেকর্ড আছে।
এবার আকস্মিক বন্যা হয়েছে। বন্যা সম্পর্কে তাদের (ভারতের) পূর্বানুমানও হয়তো কাজ করেনি।
এবার বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যথেষ্ট। ভবিষ্যতের দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে আমাদের বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনা দরকার আছে বলে মনে করেন কি?
উদয় রায়হান: হ্যাঁ, আমার মনে হয় দুর্যোগসংক্রান্ত পূর্বাভাস বা বার্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন কিছু বিষয়ের দিকে জোর দেওয়া দরকার। যেমন একটি কমন অ্যালার্ট প্রটোকলের (সিএপি) ব্যবস্থা করা যাবে। এটি বাস্তবায়িত হলে তাৎক্ষণিকভাবে এর মাধ্যমে গণমাধ্যমসহ একদম মাঠর্যায়ের সব সংশ্লিষ্ট দপ্তর দুর্যোগের আগাম বার্তা পাবে। এখন যেটা করছি, সেটা জাতীয় পর্যায়ে বার্তা দিচ্ছি। এরপর গণমাধ্যম পাচ্ছে। এটি মৌসুমি বন্যার কার্যকর পদ্ধতি। মৌসুমি বন্যার ক্ষেত্রে আমরা ৭ থেকে ১০ দিন সময় পাই। কিন্তু এ ধরনের আকস্মিক বন্যার ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পরিস্থিতির তীব্রতা সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। এটা বাস্তবায়িত হবে দেশের মধ্যেই। সিএপি বাস্তবায়িত হলে মুহূর্তের মধ্যেই বার্তা সব জায়গায় চলে যেতে পারে। টিভি বা অন্য গণমাধ্যমের স্ক্রল বলুন, মাঠপর্যায়ের দুর্যোগ কর্মীর মোবাইল ফোনে বলুন—সবখানে বার্তা চলে যাবে দ্রুত। এর জন্য একটি অ্যাপ বা কোনো একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। এ জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা–সংক্রান্ত সব দপ্তরকে এগিয়ে আসতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ
উদয় রায়হান: আপনাকেও ধন্যবাদ।