সময়মতো বাস না ছাড়ায় ও পথে দেরি হওয়ায় সকাল সাতটার বাস কক্সবাজার পৌঁছাল সাড়ে আটটায়। এরপর নাশতা সেরে ঘাটে পৌঁছাতে আরও আধঘণ্টা। এত সব ঝক্কি-ঝামেলা পেরিয়ে স্পিডবোট ছাড়তে ৯টা ৪০ বেজে গেল। যাত্রার ১৫ মিনিটের মাথায় টার্গেটের প্রথম পাখি ‘সরুচঞ্চু গঙ্গাকৈতর’-এর দেখা পেলাম, বাঁকখালী নদীর মোহনায়। তবে সে গল্প আরেক দিন হবে। আজ (২২ নভেম্বর) আমাদের মিশন এর থেকেও বিরল এক পাখির সন্ধান করা। সে কারণেই বার্ডিংবিডি ট্যুরস-এর তত্ত্বাবধানে মো. কামালের স্পিডবোটে ছুটে চলেছি সোনাদিয়া দ্বীপপুঞ্জের বেলেকেরদিয়া চরের দিকে।
ঘড়ির কাঁটায় যখন বেলা ১১টা বাজে, তখন বেলেকেরদিয়ার পাশের একচিলতে খড়ির চরে পৌঁছালাম। গত মার্চে এখানেই অতি বিরল কালো-পা গঙ্গাকৈতর ও সেপ্টেম্বরে লেসার নডি-এর সাক্ষাৎ পাই। আজ আরেকটি বিরল পাখির সন্ধানে ঠিক এখানেই এলাম। ১৬ নভেম্বর এখানেই ব্রিটিশ পক্ষিবিদ গ্যারি অলপোর্ট ও সুইডিশ পক্ষিবিদ জ্যান-এরিক নিলসেন এ দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো পাখিটির ছবি তোলেন। আগে এ দেশে মাত্র একবার পাখিটিকে দেখার রেকর্ড ছিল। কাজেই পাখিটি দেখার সৌভাগ্যবান হওয়ার আশায় আমাদের ছয়জনের এই মিশন।
যাহোক জোয়ার এসে গেছে অনেকক্ষণ। চর আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। প্রায় ৩১ মিনিট ধরে ছোট্ট এই চরের আনাচকানাচে বাইনোকুলার দিয়ে চিরুনি অভিযান চালালাম। বিশেষ করে যেখানেই গাংচিল দেখছি, সেখানেই চিরুনি অভিযান চালাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত ১১টা ৩১ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল খান ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ওই যে পাখিটি, বড় খোঁপাযুক্ত গাঙচিলের পাশে।’ সঙ্গে সঙ্গে ওর নিদের্শিত স্থানে ক্যামেরা তাক করে পাখিটির দেখা পেলাম। আর ক্লিকের বন্যা বয়ে গেল। হঠাৎই পাখিটি উড়াল দিল। দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত ক্লিক করে গেলাম। অতিবিরল ও নতুন একটি পাখি পাওয়ার আনন্দে মনপ্রাণ ভরে উঠল।
সোনাদিয়ার খড়ির চরে দেখা পাখিটি এ দেশের এক তথ্য অপ্রতুল ও অনিয়মিত পরিযায়ী পাখি স্যান্ডউইচ টার্ন। ওর কোনো বাংলা নাম নেই। তাই আপাতত স্যান্ডউইচ গাঙচিল বলেই অভিহিত করছি। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Thalasseus sandvicensis। ইংল্যান্ডের স্যান্ডউইচ শহরে প্রথম পাখিটি শনাক্ত হওয়ায় শহরের নামে পাখিটির নামকরণ করা হয়। প্রজাতিটি ইউরোপে, বিশেষ করে ক্যাস্পিয়ান সাগরের পূর্ব পর্যন্ত, উপকূল বরাবর প্রজনন করে। শীতে দক্ষিণ ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা, পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূল, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদিতে পরিযায়ন করে। অবশ্য একটি ক্ষুদ্র অংশ উত্তর-পশ্চিম ভারত ও শ্রীলঙ্কায় আসে।
এটি কালো মাথায় ছোট খোঁপাযুক্ত মাঝারি আকারের গাঙচিল। বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলুদ আগাযুক্ত সরু ও সোজা কালো চঞ্চুর মাধ্যমে সহজেই অন্যান্য গাঙচিল থেকে পৃথক করা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৮৬ থেকে ৩০৫ গ্রাম। প্রজননকালীন পাখির পিঠ ও ডানার ওপরটা ফ্যাকাশে ধূসর। কোমর ও চেরা লেজটি সাদা। হালকা গোলাপি আভাসহ দেহের নিচটা সাদা। ডানা লম্বা ও চোখা। মাথার দুপাশ ও গাল-গলা সাদা। চোখ কালচে। পা ও পায়ের পাতা কালো। স্ত্রী-পুরুষে পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরও সরু সাদা-কালো আঁশের মতো দাগ থাকে, যা বয়স বাড়ার সঙ্গে মিলিয়ে যায়।
এরা গাছপালাবিহীন নিচু তীরবর্তী দ্বীপের নুড়ি বা কর্দমাক্ত সৈকতে বংশবৃদ্ধি করে। শীতের আবাসে বালুময় উপকূল, পাথুরে সৈকত, মোহনা, পোতাশ্রয় ইত্যাদিতে থাকে। মূলত মাছখেকো, বাইম, সার্ডিন, চিংড়ি ইত্যাদি খায়। ভাটার সময় পলিমাটি থেকে সামুদ্রিক পোকামাকড়ও খেয়ে থাকে। ‘কিয়ের-ইনক’, ‘ক্রিরিক’ বা ‘ক্রিক-ক্রিক’ শব্দে ডাকে। ছানাগুলো উচ্চ স্বরে ‘সুই-সুই-সই...’ শব্দে ডাকে।
মে থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় বালুময় সমুদ্র উপকূলে সামান্য গর্ত করে কলোনা বাসা বানায়। লতাপাতা, নুড়িপাথর ও শুকনো মল দিয়ে বাসা সাজায়। ডিম পাড়ে এক থেকে দুটি; কালো দাগযুক্ত সাদা ডিম। গড়ে ২৫ দিনে ডিম ফুটে কালো ছোপযুক্ত সাদা বা হলদেটে ছানা বেরোয়। ২৮ থেকে ৩৫ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৩ থেকে ৪ বছর লাগে। আয়ুষ্কাল সচরাচর ১২ বছর।
আ ন ম আমিনুর রহমান:পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ