একাকী এক কাঠবাদামগাছ, ছেঁড়াদ্বীপ থেকে
একাকী এক কাঠবাদামগাছ, ছেঁড়াদ্বীপ থেকে

দূরদ্বীপের কাঠবাদামগাছ

গাঢ় ও নির্মল রোদ। সে রোদের আলোয় সবটুকু চোখের দেখা সমুদ্রজল যেন সবুজ রঙের এক অপূর্ব আভায় বাতাসের দোলায় ঢেউ খেলছে। সে জলে ভাসছে সামুদ্রিক শৈবাল। বাদামি রঙের। মনে হলো সারগাসাম (একপ্রকার সামুদ্রিক শৈবাল)। বড়টিকি পানচিল ডানা ভাসিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে কোথাও। তাদের ডানা সাগরের জলের ছুঁই ছুঁই দূরত্বে। হালকা বাতাসে সাগরের জল পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে ফেনা তুলছে। সমুদ্রের ঢেউয়ের একটা ছন্দ, রূপ ও গান আছে। নিমগ্ন হয়ে ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলে তবেই সেটা বোঝা যায়।

এমন সব সমুদ্ররূপ দেখতে দেখতে চলে এলাম একহারা সবুজ পাতার কেয়াবনের কাছে। তখন ছেঁড়াদ্বীপে পৌঁছে গেছে আমাদের কাঠের জলযান। গিয়েছিলাম সেখানে উদ্ভিদ গবেষণার কাজে। বাতাসে কেয়ার পাতা দুলছে। স্বচ্ছ জলের তলদেশে দেখতে পেলাম বর্ণিল মাছ, কাঁকড়া ও পাথরের গায়ে জন্মে থাকা কয়েক রঙের শৈবাল। নৌকা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে দেখতে শুরু করলাম ছোট্ট দ্বীপটি। দেখলাম দুটো ডাহুক, একটি মাছরাঙা, একটি বাদামি লাটোরা, একঝাঁক প্লোভার। কেয়াবন বাদে চোখে পড়ল কেবল ঘাস, গুল্ম ও ছোট কিছু বৃক্ষের ঝোপ।

খুবই ছোট একটি পাখির উড়ে যাওয়া দেখলাম। পাখিটি বেগুনি মৌটুসি। এত ছোট পাখি দেখে একটু ভড়কে গেলাম। কারণ, এখান থেকে টেকনাফ অনেক দূরে। সেখানে একটি বন-বাগানচারী পাখি কীভাবে উড়ে এল! পাখিরা তাদের প্রয়োজনে অনেক দূরে উড়ে যেতে পারে। পাখিটি উড়ে গিয়ে বসল দ্বীপের সবচেয়ে পুরোনো এবং বড় বৃক্ষের ডালে। বৃক্ষটি হলো কাঠবাদাম। প্রায় পুরো বাংলাদেশ ঘুরেছি, কিন্তু এত মোটা মৌটুসির মহিরুহ বাদামগাছ কোথাও দেখিনি। ছেলেবেলার গাঁয়ের বাদামগাছটির কথা মনে পড়ে গেল। সে গাছটিতে শতাধিক বাদুড় বসবাস করত। বাদাম পোক্ত হলে বাদামের বহির্ত্বক বিচিত্র এক সুন্দর বর্ণ ধারণ করত এবং নরম হয়ে যেত। বাদুড় সেই নরম অংশ খেত। খুব সকালে বাদামতলায় গিয়ে কাঠবাদাম কুড়িয়ে আমরা রোদে শুকিয়ে অনেক দিন পর কাঠবাদামের বীজ খেতাম।

দ্বীপের বাদামগাছটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম। তারপর বসে রইলাম তার তলায়। একটি গর্ত হয়েছে। সেটির ভেতর একটি চিতা অনায়াসে লুকিয়ে থাকতে পারবে। গাছটির বয়স শতোর্ধ্ব হবে মনে হলো। গাছটি সামুদ্রিক ঝড়–বাতাস উপেক্ষা করে টিকে আছে। আশা করি, বাদামগাছটি ছোট্ট এই দ্বীপে টিকে থাকবে আরও অনেক বছর ধরে।

প্রশান্ত মহাসাগরের মেলেশিয়া দ্বীপ এলাকা হলো কাঠবাদামের আদি নিবাস। এ দ্বীপগুলো মূলত উষ্ণমণ্ডলীয় গাছপালায় সমৃদ্ধ। সেখান থেকে সাগরের জলে বীজ ভেসে ভেসে ছড়িয়ে পড়েছে উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায়। ছেঁড়াদ্বীপের বয়সী কাঠবাদামগাছটি এভাবেই সেখানে একদিন বসতি গড়েছে।

কাঠবাদাম বাংলাদেশের অনেক জেলায় দেখা যায়। বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে। ঢাকা শহরের রমনা পার্কে কয়েকটি কাঠবাদামগাছ আছে। ঢাকার সংসদ ভবনের সামনে, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ বরাবর একটি কাঠবাদাম গাছ ছিল। বছরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাছটির পাতার রং পরিবর্তন হতো। আমি প্রায়ই পাতার রঙের পরিবর্তন দেখতে গাছটির তলায় গিয়ে দাঁড়াতাম। সেই গাছটি কে বা কারা কেটে ফেলেছে। কাঠবাদাম ছায়াতরু এবং দৃষ্টিনন্দন তরু হিসেবে মানানসই। কাঠবাদামের পাতাসমেত শাখা–প্রশাখা বড়ই দৃষ্টিনন্দন। শীতের সময় পাতার রং সিঁদুর লাল হয়ে যায়। সে দৃশ্য দেখতে বড়ই মনোহর। কাঠবাদামের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি হয়। বাদামের বীজ গ্রামবাংলার কিশোর-কিশোরীদের কাছে অতি জনপ্রিয়। ঢাকা শহরের বিরল পাখি চন্দনা টিয়ার অন্যতম প্রধান খাবার কাঠবাদামের বীজ। কোস্টারিকার দুই প্রজাতির ম্যাকাও পাখির অন্যতম খাদ্য হলো এই বাদামের বীজ ও পাকা বহির্ত্বক।

নানা কারণে, বিশেষ করে অপরিকল্পিত পর্যটনের কারণে ছেঁড়াদ্বীপের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। ছেঁড়াদ্বীপসহ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে অপরিকল্পিত পর্যটন বন্ধ করা উচিত বলে মনে করি।