মিসরের শার্ম আল-শেখ অবকাশ যাপন কেন্দ্রে আজ শনিবার রাতে শোনা যাবে বাংলাদেশের কথা। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির জুরাছড়ির প্রত্যন্ত পাঁচ গ্রামের নারীদের অর্জনের কথা সেখানে শুনবে সারা বিশ্ব। শার্ম আল-শেখে চলছে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন। সেই সম্মেলনে জলবায়ু অভিযোজনে অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশনের (জিসিএ) ‘লোকাল অ্যাডাপটেশন চ্যাম্পিয়নস অ্যাওয়ার্ড’ পাচ্ছে জুরাছড়ির নারীদের এ উদ্যোগ। নারীদের উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতা করে এ পুরস্কার পাবে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ।
১৭০টি দেশের মধ্যে থেকে ৪টি দেশের ৪ প্রকল্পকে এবার বেছে নিয়েছে জিসিএ। এর মধ্যে রাঙামাটি জেলা পরিষদ ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব’ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার পাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে মানুষের পানির কষ্টের কথা অজানা না। আর এ কষ্ট বেশি পোহাতে হয় নারীদেরই। পানির সমস্যা লাঘবে পাহাড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা কাজ করে। তারা সমাধানের চেষ্টাও করে। পানির জন্য হাপিত্যেশ, উন্নয়ন সহযোগীদের প্রকল্প, কষ্ট লাঘবের ‘সাফল্য গাথা’ এসব শোনা যায় প্রায়ই। জুরাছড়ির নারীরা নিজেদের পানির কষ্ট লাঘব করেছেন। তাঁদের কাজে রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা ছিল বটে। কিন্তু পানির জন্য নারীদের সংগ্রাম ও কাজের অভিনবত্ব জুরাছড়ির নারীদের এ সম্মান দিয়েছে।
জুরাছড়ির নারীদের এ উদ্যোগ নিয়ে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন, ‘উদ্যোগটি স্থানীয় ও প্রথাগত ব্যবস্থাপনার এক সম্মিলিত রূপ। প্রান্তিক পর্যায়ে জলবায়ু অভিযোজনের জন্যই এটি করা হয়েছে। তাদের এই উদ্যাগ শুধু টেকসই–ই নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় এ উদ্যোগ যথাযথভাবে এবং কার্যকরভাবে অন্যরাও অনুসরণ করতে পারে।’
জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে কাজ করা বৃহত্তম সংস্থা জিসিএ। এর সদর দপ্তর নেদারল্যান্ডসের রটেরড্যামে। প্রতিষ্ঠানটির কো-চেয়ার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন। মোট চারটি ক্যাটাগরিতে এবার পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। সেগুলো হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক নেতৃত্ব, আর্থিক সুশাসন, সক্ষমতা এবং জ্ঞান ও স্থানীয় উদ্ভাবন। রাঙামাটি জেলা পরিষদ ছাড়া বাকি তিন পুরস্কার পাওয়া প্রতিষ্ঠান হলো ভারতের পুনের বেসরকারি সংগঠন স্বয়াম শিক্ষণ প্রয়োগ, নেপালের বেসরকারি সংগঠন কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি ফোরাম, নেপাল (সিডিএএফএন) এবং কেনিয়ার সংগঠন অ্যাডাপটেশন কনসোর্শিয়াম।
পাহাড়ের অধিবাসী হিসেবে পানির কষ্ট ছোটবেলা থেকেই পেয়েছেন জনা চাকমা। তাঁর বাড়ি জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম চৌমহনী গ্রামে। স্বামী ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। ছোট পরিবার হলেও পানির কষ্ট তো কম নয়। প্রায় এক ঘণ্টা পায়ে হাঁটাপথে বনযোগী ছড়া থেকে পানি আনতে হতো। সেই পানিতে খাওয়াদাওয়া, গোসলসহ সব প্রয়োজন মিটত। শুকনা মৌসুমে ছড়ার পানি কমে এলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে যেত।
জনা বলছিলেন, ‘গরমের দিন। খাবারের পানি আনতেই সময় চলে যেত। গোসলের পানি ছিল একটা বিলাসিতা। কী কষ্ট করেছি তা বলার মতো না।’
কষ্ট হলেও ছড়ার পানি দিয়ে তবু প্রয়োজন মিটত। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রবল ভূমিকম্পে ছড়া নষ্ট হয়ে যায়। পানির কষ্ট আরও বাড়ে। চৌমহনী, বাদলপাড়া, লক্ষ্মী মেম্বার পাড়া, এনকে পাড়া ও চেয়ারম্যান পাড়া কাছাকাছি কয়েকটি গ্রাম। জুরাছড়ি সদর থেকে এসব গ্রামের দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। গ্রামগুলোর মানুষের অভিন্ন কষ্ট পানির।
গত বছর এসব গ্রামে জলবায়ু সহিষ্ণুতা প্রকল্পের কাজ নিয়ে এলাকাগুলোতে যায় রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ। এ কাজে তাদের সহযোগিতা করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ডেনমার্ক উন্নয়ন করপোরেশন (ডানিডা)। প্রয়োজনীয়তার নিরিখে কোনো প্রকল্প নেওয়ার কথা যখন বলা হলো তখন একজোট হলেন এসব গ্রামের নারীরা। পাঁচ গ্রামের প্রতিটিতে একটি করে কমিটি হলো। তাতে একজন পুরুষ ও একজন নারী। মোট ১০ জনের কমিটি হলো। এ কমিটির নাম কমিউনিটি রেসিলিয়ান্স কমিটি (সিআরসি)। সেখানে থাকলেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) ও কার্বারিরাও (পাড়াপ্রধান)।
রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলছিলেন, ‘আমরা যখন প্রকল্পটি নিয়ে গেলাম, তখন নারীরা সকলে মিলে বললেন, যে প্রকল্পই নেওয়া হোক, তা যেন তাঁদের পানির কষ্ট দূর করে। তাঁদের এ দাবির প্রতি সমর্থন ছিল পুরুষদেরও। নারীদের কষ্ট পুরুষেরা এতকাল অনুভব করেছেন, কার্যকর কিছু করতে পারেনি। নারীরা কষ্ট অনুভব করেছেন আবার বাস্তবায়নের পথও দেখিয়েছেন তাঁরাই।’
ভূগর্ভস্থ পানি ওঠানোর জন্য গভীর নলকূপ স্থাপিত হয়েছে বাদলপাড়া গ্রামে। রাখা আছে পাঁচ হাজার লিটার ধারণক্ষমতার পানির ট্যাংক। সেখান থেকে পাইপ দিয়ে গ্রামগুলোতে পানি যায়। কিছু গ্রামে এখনো যায়নি। সেখানকার নারাীর বাদলপাড়ায় এসে পানি নিয়ে যান।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি প্রসেনজিত চাকমা বলেন, ‘নারী-পুরুষনির্বিশেষ স্থানীয় অধিবাসীদের পাশাপাশি এই কমিটিতে যুক্ত। কিন্তু এর নেতৃত্বে নারীরা। এটিই এ প্রকল্পের অভিনবত্ব।’
এ প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য বিষয় ছিল, স্বল্প খরচে পানি উত্তোলন করতে হবে। বিদ্যুতের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না, তাই সৌরবিদ্যুতে ভর করেই হলো নলকূপ স্থাপন। নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি কার্যকর উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়। জিসিএর স্বীকৃতি অর্জনে এই বিষয়টিও কাজ করেছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) সাবেক লিড অথর আতিক রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের নারীদের এই স্বীকৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জিসিএর এই স্বীকৃতি আমাদের নীতিনির্ধারকদের তো বটেই, বিশ্বকেও আমাদের সাফল্যের বার্তা দেবে।’
এখন এই নলকূপ পরিচালনা কমিটি নলকূপ পরিচালনা করে। নারীরা একটি তহবিল গঠন করেছেন, যা দিয়ে নলকূপ প্রয়োজনীয়তা বুঝে নলকূপ সারাইয়ের কাজ হবে। এসবই দেখভাল করেন নারীরা। পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট এখন অতীত।
বাদলপাড়া গ্রামের ঝরনা চাকমা বলছিলেন, ‘আমাদের জীবন অনেক সাবলীল হয়ে গেছে। পানির জন্য যে সময় যেত সে সময়ে এখন কাপড় বোনাসহ নারা কাজ করতে পারি। ছেলেমেয়েদের দিকে নজর দিতে পারি।’
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার নারীদের একটি প্রকল্পের এই স্বীকৃতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি-বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি এখন মিসরের জলবায়ু সম্মেলনে আছেন। সেখান থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈশ্বিক ভাবনা আর স্থানীয় পর্যায়ে কাজ—এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে জুরাছড়ির নারীদের এ উদ্যোগে। আশা করি, সরকার এতে উদ্বুদ্ধ হবে। আর কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগোবে।’
রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগাড়াছড়ি এই তিন জেলা পরিষদ নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৯৮৯ সালে প্রথম এই তিন জেলার পৃথক স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয় সরাসরি। ১৯৯৭ সালে সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ফলে নতুন করে তিন জেলা পরিষদ গঠিত হয়। এরপর আর সরাসরি নির্বাচন না হলেও মনোনীত প্রার্থীদের মাধ্যমেই চলছে জেলা পরিষদগুলো। স্থানীয় সরকারের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিছু সীমাবদ্ধকতা থাকার পর বাংলাদেশের বাকি ৬১ জেলা পরিষদের তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন এ তিন জেলা পরিষদ। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেন, ‘স্থানীয় প্রেক্ষাপটে স্থানীয় নানা বিষয় ধারণ করে এসব জেলা পরিষদ, যা তিন জেলা পরিষদকে ভিন্নতা দিয়েছে।’
জুরাছড়ির গ্রামে জেলা পরিষদের প্রকল্পটি পরিষদ কর্তৃপক্ষ চাইলে ভিন্ন ধরনের হতে পারত। কিন্তু পরিষদ কর্তৃপক্ষই বলেছে, তারা স্থানীয় নারীদের প্রয়োজনীয়তাকে উপলদ্ধি করতে পেরেছে।
স্থানীয় মানুষের চাহিদা তো নানা ধরনের থাকে। তার মধ্য থেকে গুরুত্বের নিরিখে, বাস্তবতা বুঝে নির্বাচনটা গুরুত্বপূর্ণ। রাঙামাটি জেলা পরিষদ সেই কাজটি সফলভাবে করতে পেরেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালাহউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ প্রকল্পটি নারীর ক্ষমতায়নের একটি কেসস্টাডি। এর গুরুত্ব জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ বুঝতে পেরেছে, কারণ তাদের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে স্থানীয় সমস্যার সমাধান এটি বড় বিষয়। বিশ্ব পরিসরে বাংলাদেশের একটি জেলা পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান মর্যাদা পাচ্ছে এটি আমাদের নীতিনির্ধারকদের জন্য শিক্ষণীয়। রাঙামাটি জেলা পরিষদের এটি অনন্য অর্জন।’
আজ শনিবার বাংলাদেশের সময় রাত আটটায় জলবায়ু সম্মেলনে এ পুরস্কার নেবেন রাঙামাটি জেলা পরিষদের প্রতিনিধি অরুনেন্দু ত্রিপুরা। পুরস্কারের অর্থ ১৫ হাজার পাউন্ড।