বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ভারতের ওডিশা উপকূলে আছড়ে পড়া ‘দানা’ প্রবল ঘূর্ণিঝড় ছিল। এর প্রভাবে ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হয়েছিল। আর ঘূর্ণিঝড়ের ডান পাশে থাকার কারণে বাংলাদেশের উপকূলেও এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কার কথা বলেছিলেন আবহাওয়াবিদেরা। দানার প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলের অন্তত ১৪ জেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুটের বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস দিয়েছিল আবহাওয়া অধিদপ্তর।
দানাকে নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে যে ভীতি তৈরি হয়েছিল, ততটা সংহারী হয়নি ঘূর্ণিঝড়টি। ওডিশার উপকূলের ভিতরকণিকা এলাকা দিয়ে এটি প্রবেশ করে। তাতে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ায় কিছুটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু কোনো প্রাণহানি নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিঘাসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝোড়ো হাওয়ার পাশাপাশি বৃষ্টি হলেও তেমন কোনো ক্ষতির খবর নেই। বলা হয়েছিল, কলকাতায় ৮০ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইবে। বাস্তবে তা ৪০ কিলোমিটারের বেশি হয়নি।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছিল, প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির সামনের অংশের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং এসব এলাকার কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে দুই থেকে তিন ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং এর কাছের দ্বীপ ও চরগুলোর ওপর দিয়ে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টি) থেকে অতি ভারী (৮৯ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি) বৃষ্টি হতে পারে বলেও জানিয়েছিল আবহাওয়া অফিস।
বাস্তবে শুধু মোংলায় ২৫ কিলোমিটার বেগে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। কিছু গাছ উপড়ে যায় উপকূলের কিছু এলাকায়। এর বেশি কিছু হয়নি।
এ নিয়ে বাংলাদেশের আবহাওয়াবিদেরা অন্তত ছয়টি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক মনে করেন, প্রথম কারণ হলো দানার ব্যাপ্তি কম ছিল। অর্থাৎ এই ঘূর্ণিঝড়ের বিস্তৃতি ছিল না ততটা। স্বল্প পরিসরের মধ্যে এটি আবদ্ধ ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপ্তি যত বেশি হয়, তার প্রভাবও বেশি হয়। দানার ক্ষেত্রে তা হয়নি।
দানার প্রভাব বেশি দূর পর্যন্ত বিস্তৃত না হওয়ার বা কম শক্তিশালী হওয়ার দ্বিতীয় কারণ ‘অ্যান্টিসাইক্লোন’। যে সময় দানা উপকূল অতিক্রম করেছে, সে সময় এ অঞ্চলে দুটি ‘অ্যান্টিসাইক্লোন’ সক্রিয় ছিল। এর একটি মধ্য ভারতে এবং অন্যটি মিয়ানমার থেকে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, এই ‘অ্যান্টিসাইক্লোন’-এর প্রভাবে দানার গতিপথে শুষ্ক হাওয়া প্রবেশ করে। আর এই শুষ্ক হাওয়ার কারণে দ্রুত শক্তি হারায় দানা। এটি এর কমজোর হওয়ার একটি কারণ।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, একটি ঘূর্ণিঝড়ের মূল ‘জ্বালানি’ হলো জলীয় বাষ্প। এটি বেশি থাকলে ঘূর্ণিঝড় প্রবল থেকে প্রবলতর হয় বা বেশি শক্তিশালী হয়ে যায়; কিন্তু দানার জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ছিল কম।
ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রমের সময় এর ওপরের বাতাসের গতিবেগ ও ভূপৃষ্ঠের গতির পার্থক্য বেশি থাকলে এর শক্তি কম হয়। তবে পার্থক্য কম থাকলে শক্তি বেশি হয়। দানার বাতাসের গতিবেগ ও ভূপৃষ্ঠের গতির পার্থক্য বেশি থাকার কারণে এটি তেমন শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি।
দানা কম শক্তিশালী হওয়ার ষষ্ঠ কারণ, এর গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরির শক্তি অপেক্ষাকৃত কম ছিল। দানা ওডিশা উপকূল দিয়ে স্থলভাগে প্রবেশের পরপরই দুর্বল হতে শুরু করে। এ কারণেই তার প্রভাব থেকে রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশের মতো আশপাশের এলাকাগুলো।
আবুল কালাম মল্লিক বলেন, এক ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে অন্য ঘূর্ণিঝড়ের মিল থাকে না সাধারণত। সব ঘূর্ণিঝড়েরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। ‘প্রবল’ হওয়া সত্ত্বেও ঘূর্ণিঝড় দানা ততটা শক্তিশালী হতে পারেনি এর অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে। এতে ভারত ও বাংলাদেশের উপকূলের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে।