পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে পিটিয়ে মেরে ফেলা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘটি। গত ফেব্রুয়ারিতে
পঞ্চগড়ের আটোয়ারীতে পিটিয়ে মেরে ফেলা পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘটি। গত ফেব্রুয়ারিতে

বন্য প্রাণী

উত্তরের হতভাগ্য চিতাবাঘেরা

গত ফেব্রুয়ারিতে পঞ্চগড়ে আবার একটি চিতাবাঘ মারা পড়েছে। বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় চিতাবাঘের চলাফেরা সব সময়ই ছিল। গত ১৪ বছরে প্রায় ১০টি বাঘ এলাকার লোকালয়ে চলে আসে এবং মানুষের হাতে মারা পড়ে। আর একবার লোকালয়ে ঢুকে পড়লে খুব কম সংখ্যক চিতাবাঘ বনে ফিরে যেতে পেরেছে। মানুষের অসচেতনতায় বিরল এই প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে। ফলে গোটা দেশ থেকেই চিতাবাঘ হারিয়ে যেতে বসেছে।

চিতাবাঘের (প্যানথেরা পারডাস) খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা অসাধারণ। সুদূর রাশিয়ার ভ্লাদিভস্টক থেকে তুরস্কের আনাতোলিয়া, মরক্কোর অ্যাটলাস পর্বতমালা থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপে তাদের আনাগোনা। এমনকি বলিউডের প্রাণকেন্দ্র মুম্বাই শহরের পাশে সঞ্জয় গান্ধী জাতীয় উদ্যানে প্রায় ১০০টি চিতাবাঘ আছে। সেগুলো মাঝেমধে৵ শহরেও ঢুকে পড়ে। ২০১৫ সালে গণনা অনুযায়ী, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো ছাড়া ভারতে প্রায় আট হাজার চিতাবাঘ আছে। পুরো ভারতে ১২ থেকে ১৪ হাজার চিতাবাঘ আছে বলে ধারণা করা হয়।

একসময় সারা বাংলাদেশেই চিতাবাঘ ছিল। ’৭০-৮০ দশকেও ভাওয়ালের শালবনে চিতাবাঘ মারা পড়ার নথিভুক্ত তথ্য আছে। দূরের বিরান এলাকাগুলোয় কী অবস্থা ছিল সহজেই অনুমেয়। অথচ সব সময়ই বলে আসা হয়েছে, দেশে চিতাবাঘ বিলুপ্তির পথে। গত ২০ বছরে ২৫টির মতো চিতাবাঘ দেশের নানা প্রান্তে দেখা গেছে। কিছু উদ্ধার হয়েছে চোরাচালানিদের কাছ থেকে। বড় হচ্ছে সাফারি পার্কে। বর্তমানে বাংলাদেশে চিতাবাঘের ভরসা করার মতো স্থায়ী আশ্রয় মৌলভীবাজার, চট্টগ্রাম আর পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বন। তাহলে বৃহত্তর রংপুরে চিতাবাঘের আনাগোনার বিষয়টি কী হতে পারে?

পাশের পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার আর আলিপুরদুয়ারে বেশ কিছু চিতাবাঘ থাকে। সেগুলো থাকে চা-বাগানে মানুষের সঙ্গেই। এসব এলাকায় চিতাবাঘের আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার তথ্য নেই বললেই চলে। মানুষের হাতে চিতাবাঘ মারা যাওয়ার হারও কম। আমাদের তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের বিরানভূমি আর ভুট্টা ও আখখেতগুলো ভূপ্রকৃতিগতভাবে একই রকম, ভারতে এ রকম নানা এলাকায় চিতাবাঘ স্বচ্ছন্দে বাস করে। আমাদের চিতাবাঘ নিয়ে প্রায়ই বলা হয়, এগুলো পথ ভুল করে কিংবা খাবারের খোঁজে চলে এসেছে। কিন্তু এসব এলাকায় আমরা তো গবেষকের চোখ দিয়ে কোনোদিন ভালো করে দেখিওনি। ভারত থেকে আসে, নাকি আমাদের এখানে সব সময়ই দু-চারটি ছিল, এখনো আছে? ধারাবাহিকভাবে এ অঞ্চলে চিতাবাঘের মৃত্যু সেদিককেই ইঙ্গিত করে।

এবার পঞ্চগড়ের ঘটনার পর বেশ অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করলাম। শুরুতে বলা হয়েছিল, চিতাবাঘটি বয়স্ক আর ক্ষুধার্ত। মৃত অবস্থায় সীমান্তের কাছে পড়ে ছিল। খবরটি পাওয়ার পর অনেকেই আমাকে ঘটনাস্থলের ভিডিও পাঠিয়েছেন। স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, বাঘটি জাল দিয়ে ধরে ফেলা হচ্ছে, পেটানো হচ্ছে আর পানিতে চুবানো হচ্ছে। আর বিড়াল–জাতীয় প্রাণীর বয়সের ব্যাপারটি কিন্তু সহজেই দাঁত আর থাবা দেখে বোঝা যায়। এটি ছিল একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘ, স্বাস্থ্যবান। ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল। মৃত বন্য প্রাণীর বয়সের ব্যাপারটি দেখেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা। বন ও বন্য প্রাণীর দায়িত্বে আছেন যাঁরা, তাঁদেরই এ বিষয়টি দেখা উচিত। চিতাবাঘের মৃত্যুর পর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি?

চিতাবাঘ কিন্তু আমাদের উত্তরাঞ্চলে আসবেই, থাকবেই। জন্মভূমির টান কিন্তু আলাদা বিষয়। সব কটিকে ‘বুড়ো’ আর ‘সীমান্তের কাছ থেকে পাওয়া গেছে’ বলে কিন্তু রায় দেওয়া যাবে না। বাঘের পরে চিতাবাঘ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিড়াল–জাতীয় প্রাণী। কিন্তু এর বিপরীতে নেই কোনো গবেষণা। জীবিত উদ্ধার করে পাহাড়ি বনে ছাড়ার মতো চিন্তাও তো আমরা করতে পারি।

বন্য প্রাণী কি শুধু সুন্দরবনেই থাকবে? মানুষের সঙ্গে কি বন্য প্রাণী থাকতে পারবে না? সে পাখি হোক, মেছো বিড়াল, বেজি কিংবা চিতাবাঘ? ভারতে তো থাকছে, নেপালে থাকছে—এমন সব জায়গায় যেগুলো ঘনবসতিপূর্ণ, শিক্ষার হার আমাদের মতোই। বাংলাদেশে মানুষ ও বন্য প্রাণীর মধে৵ সম্পর্ক যেকোনো সময়ের চেয়ে তলানিতে অবস্থান করছে। সত্য মেনে নিয়ে এ সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের ভাবা দরকার।

  • মুনতাসির আকাশ, সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়