সুন্দরবন এলাকায় জলকেলিতে মেতেছে ডলফিনটি
সুন্দরবন এলাকায় জলকেলিতে মেতেছে ডলফিনটি

দেশের ১৪ নদীতে টিকে আছে বিলুপ্তপ্রায় গাঙ্গেয় শুশুক

বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে গাঙ্গেয় শুশুক। ডলফিনের মহাবিপন্ন এ প্রজাতি সবচেয়ে বেশি টিকে আছে বাংলাদেশে। তবে নিজ বসতি এলাকা বা নদ-নদীতে বেশ বিপদে রয়েছে এরা। জলাভূমির গুরুত্বপূর্ণ ও বিলুপ্তপ্রায় এ প্রাণীকে রক্ষায় জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ দেশের অধিকাংশ নদীতে গাঙ্গেয় শুশুক দেখা যেতে। তবে এক যুগ ধরে শুধু সুন্দরবন ও আশপাশের নদীগুলো ছাড়া আর কোথাও এটি খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। দেশের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা দেশের ১৪টি নদ–নদীতে এ গাঙ্গেয় ডলফিন খুঁজে পেয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ও বন বিভাগের বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘ গবেষণা সমীক্ষায় এসব তথ্য পেয়েছেন। চলতি মাসে সমীক্ষার ফলাফল বাংলাদেশ প্রাণিবিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বন বিভাগ ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) যৌথভাবে গবেষণাটিতে সহায়তা করেছে।

কোনো একটি নদীর পানি ও পরিবেশ কতটুকু ভালো আছে, তা বোঝা যায় সেখানে শুশুক টিকে আছে কি না, তা দেখে। ফলে নদী ও প্রকৃতি রক্ষার একটি সূচক হচ্ছে শুশুক।
—আবদুল আজিজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক

নানা তথ্য বেরিয়ে এলেও দেশে ডলফিনের মোট সংখ্যা কত, তা নিশ্চিত করে সমীক্ষায় উঠে আসেনি। বন বিভাগ থেকে বলা হয়, দেশে শুশুকের সংখ্যা ছয় থেকে আট হাজার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আছে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন। বিশ্বে এ দুই প্রজাতির ডলফিনের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশে রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বন্য প্রাণী গবেষণা সংস্থা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

এ ব্যাপারে গবেষক দলের প্রধান ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের যেসব নদ–নদীতে এখনো শুশুক টিকে আছে, তা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি। যে নদীগুলোতে এরা এখনো টিকে আছে, সেখানে তাদের সুরক্ষা দিতে হবে। কারণ, কোনো একটি নদীর পানি ও পরিবেশ কতটুকু ভালো আছে, তা বোঝা যায় সেখানে শুশুক টিকে আছে কি না, তা দেখে। ফলে নদী ও প্রকৃতি রক্ষার একটি সূচক হচ্ছে শুশুক।’

বিপদে শুশুক, প্রয়োজন জরুরি পদক্ষেপ

গবেষণায় শুশুকেরা বেশ বিপদে রয়েছে বলে দেখা গেছে। তবে দেশে শুশুক রক্ষার ক্ষেত্রে শুধু সুন্দরবন ও এর আশপাশের এলাকাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে বন বিভাগের বন সংরক্ষক (বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ) ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডলফিন আছে এমন এলাকাগুলোতে আমরা ডলফিনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করছি। ডলফিন রক্ষায় একটি কর্মপরিকল্পনা করা হচ্ছে।’

গবেষণায় গাঙ্গেয় ডলফিনের দুই ধরনের বিপদ চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথমত, সরাসরি বিপদের দিক তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়, নদীতীরবর্তী এলাকার মানুষ প্রথা বা বিশ্বাসের অংশ হিসেবে ডলফিনের তেল ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। এটি করতে গিয়ে জেলেদের মাধ্যমে শুশুক ধরে বা মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়লে তা নিয়ে যান তাঁরা। আবার অনেক ক্ষেত্রে মাছ ধরতে শুশুকের তেল ব্যবহার করা হয়। এসব কারণে নদীতে গাঙ্গেয় শুশুক কমে আসছে ও হুমকির মুখে পড়ছে।

বিশ্বে গাঙ্গেয় ও ইরাবতী—এই দুই প্রজাতির ডলফিনের ৮০ শতাংশ বাংলাদেশে রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির সমীক্ষায় উঠে এসেছে।

দ্বিতীয়ত, নদ-নদীতে বাঁধ ও সেচ অবকাঠামো নির্মাণে ডলফিনের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন ফারাক্কা বাঁধের কারণে গাঙ্গেয় ডলফিনের চলাচলে সবচেয়ে বড় বাধা তৈরি হয়েছে। দেশের ভেতর কর্ণফুলী, হালদা ও মেঘনা নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণের কারণেও বিপদ বেড়েছে ডলফিনের।

গবেষক দলটির একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডলফিনের জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকি ইঞ্জিনচালিত নৌকা। মূলত পর্যটকবাহী বড় লঞ্চ, ড্রেজার বা খননযন্ত্র ও বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত বিশেষ নৌযানে ডলফিন বেশি আঘাত পায়। শীতকালে সুন্দরবনসহ আশপাশের এলাকায় দিন ২৬৭টি নৌযান চলাচল করে। আর ড্রেজার চলে ৬৬টি। এসব নৌযান ও যন্ত্রের আঘাতে মারা যায় অনেক ডলফিন।

ডলফিনের বসবাসের জন্য উপযুক্ত নদীগুলোর মধ্যে চট্টগ্রামের হালদা ও কর্ণফুলীকে ধরা হয়। এ দুই নদীতে প্রায় ৫০টি শুশুক আছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। কিন্তু এ দুই নদীতেও মাছধরা নৌকা, রাবার ড্যামসহ নানা অবকাঠামোর কারণে প্রতিবছর একাধিক শুশুকের মৃত্যু হয়।

শুশুক পাওয়া গেছে পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলের নদীগুলোতেও। সুন্দরবনের নদীগুলোর মধ্যে শেলা, সুপতি, পশুর ও বলেশ্বরে সবচেয়ে বেশি ডলফিন আছে। নদীগুলোর মধ্যে পশুর নদীর উজানে ১৫ কিলোমিটার, পদ্মার রাজশাহী অংশে গোদাগাড়ি, ব্রহ্মপুত্রের কুড়িগ্রামের চিলমারী, মেঘনার ভৈরবে আছে বেশি ডলফিন। এ ছাড়া ধরলা, তিস্তা, কুশিয়ারা, সাঙ্গুতে ডলফিন আছে। কর্ণফুলী ও সাঙ্গুতে আগের একটি সমীক্ষায় ১২৫টি ডলফিন পাওয়া গিয়েছিল। কাপ্তাই হ্রদেও ডলফিন ছিল একসময়।

গবেষণায় ডিউওয়ার্ট রিচম্যান নামের একজন গবেষকের তথ্যে ২০১০ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৭০টি ডলফিন ধরা ও ১৪টি মারা যাওয়ার চিত্র উঠে আসে। গবেষক দলটি মাছের বাজারে তিনটি ডলফিন বিক্রির ঘটনার প্রমাণ পান। যেখানে মূলত মাছ ধরার জালে শুশুকগুলো আটকা পড়ার পর জেলেরা বাজারে নিয়ে বেশি দামে তা বিক্রি করেন। এর মধ্যে একটি ঘটনায় জেলেরা শুশুককে স্থানীয় পুকুরে ছেড়ে দেন। কিন্তু এক দিনের মাথায় মারা যায় সেটি।

মাছ ধরতে গিয়ে জালে ডলফিন আটকা পড়লে ৪৫ শতাংশ জেলেই তা ছেড়ে দেন না বলে সমীক্ষায় দেখা গেছে। তাঁদের ১৮ শতাংশ ডলফিন থেকে তেল সংগ্রহ ও অন্য জেলের কাছে বিক্রি করে দেন। ভারতের আসামে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীর মানুষ ডলফিন শিকার ও এর তেল ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেদের মধ্যে তেল সংগ্রহে ডলফিন শিকারের ঘটনা কম। জালে ধরা পড়ে মারা গেলে জেলেরা তা থেকে তেল সংগ্রহ করেন।

দেশের ভেতর শিল্পকারখানার দূষণ ও নদী দখলের কারণেও অনেক ডলফিন মারা যায়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদে একসময় প্রচুর ডলফিন দেখা যেত। শীতলক্ষ্যা ও বালু নদে এখনো কালেভদ্রে এদের দেখা যায়। এ চার নদ–নদীতে বছরে ফেলা হচ্ছে ১৫ লাখ কিউবিক মিটার দূষিত শিল্পবর্জ্য। এসব নদীর চারপাশে গড়ে উঠেছে সাত হাজারের মতো শিল্পকারখানা। কারখানাগুলো থেকে নির্গত হওয়া দূষিত পদার্থের ভাগাড়ে পরিণত হওয়া এ নদীগুলো থেকে শুশুক বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে।

এদিকে ডলফিন রক্ষায় সুন্দরবনের ভেতর ছয়টি অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে ডলফিনের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ডলফিন রয়েছে, এমন আরও ১০টি নদ-নদীর ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মত দেন বিশেষজ্ঞরা।