হঠাৎ দেখা রাজধনেশ

গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের পক্ষিশালায় একটি রাজধনেশ
ছবি: লেখক

এক যুগ আগের ঘটনা। পারিবারিক ভ্রমণে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁর উদ্দেশে। সোনারগাঁর নানা জায়গায় ঘুরেফিরে পৌঁছালাম লোকশিল্প জাদুঘরে। আদিতে এটি ছিল বারো ভূঁইয়ার প্রধান জমিদার ঈসা খাঁর জমিদারবাড়ি।

সেদিন জমিদারবাড়িতে বেশ ভিড়। তাই ভেতরে ঢুকলাম না। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে এদিক-সেদিক দেখছি। আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ আকাশের দিকে যেতেই আকস্মিকভাবে বিচিত্র মাথার এক পাখি উড়তে দেখলাম। মাত্র দুটি ক্লিক করার পর পাখিটি এতটাই দূরে চলে গেল যে বিন্দুর মতো দেখাল।

ভিউ ফাইন্ডার থেকে চোখ নামিয়ে ক্যামেরার স্ক্রিনে ছবি দুটি জুম করলাম। মাথা চক্কর দিয়ে উঠল! কারণ, দূরের ছবি জুম করায় কিছুটা ঝাপসা লাগলেও পাখিটি চিনতে কষ্ট হলো না। কিছুতেই বুঝতে পারলাম না এই পাখি এখানে এল কীভাবে? রহস্যের জট কোনোভাবেই খুলতে পারলাম না।

পরে চাচাতো ভাই আমিনুল ইসলাম স্বপনের কাছে ঘটনাটি খুলে বলতেই সে ছবিটি দেখতে চাইল। ছবি দেখে বলল, তার শ্বশুরবাড়ির ঘরের চালে এ রকম একটি পাখি দেখেছিল কিছুদিন আগে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেউ একজন পাখিটি পোষার জন্য এনেছিল। তবে কোত্থেকে ও কীভাবে এনেছিল তা জানা যায়নি। একদিন খাঁচার দরজা খোলা পেয়ে পাখিটি পালিয়ে যায়। সম্ভবত তখনই আমি ওকে উড়তে দেখেছিলাম। পাখিটি পালিয়ে যাওয়ায় অবশ্য খুশিই হয়েছিলাম।

সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর চত্বরের আকাশে আকস্মিকভাবে দেখা পাখিটি এ দেশের বিরল ও শঙ্কাগ্রস্ত আবাসিক পাখি রাজধনেশ বা বড় ধনেশ। পশ্চিমবঙ্গে বড় কাও ধনেশ নামে পরিচিত। ইংরেজি নাম গ্রেট ইন্ডিয়ান বা গ্রেট পাইড হর্নবিল। গোত্র বুসেরোটিডি। বৈজ্ঞানিক নাম Buceros bicornis। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

ধনেশ পরিবারের বৃহত্তম সদস্যের গড় দৈর্ঘ্য ১৩০ সেন্টিমিটার ও প্রসারিত ডানা ১৫১ থেকে ১৭৮ সেন্টিমিটার। পুরুষ ও স্ত্রীর ওজন যথাক্রমে ২ দশমিক ৬০ থেকে ৩ দশমিক ৪০ এবং ২ দশমিক ১৫ থেকে ৩ দশমিক ৩৫ কেজি। মুখমণ্ডল ও বুক কালো। লম্বা গলাটি হলদে। পিঠ, ডানা ও দেহতলে সাদা–কালোর চমৎকার সমন্বয়। সাদা লেজের শেষ প্রান্তের কাছে কালো ডোরা। বিশাল হলুদ চঞ্চু নিচের দিকে বাঁকানো।

ওরা চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের চিরসবুজ বনের বাসিন্দা হলেও বর্তমানে বান্দরবানের সাঙ্গু উপত্যকায়ই বেশি দেখা যায়। আমি কখনো সাঙ্গুতে যাইনি বলে পাখিটিকে বুনো পরিবেশে দেখিনি। তবে ২০১৭ সালে ভারতের উত্তরাখন্ড প্রদেশের বিশ্বখ্যাত জিম করবেট জাতীয় উদ্যানে একবার দেখেছিলাম।

অত্যন্ত লাজুক এ পাখি সচরাচর একাকী বা জোড়ায় গাছের বেশ উঁচুতে বিচরণ করে। মাটিতে পড়া পাকা ফল ও বাসার মুখ আটকানোর জন্য মাটি সংগ্রহ ছাড়া সহজে নিচে নামে না। মূলত ফলখেকো হলেও প্রয়োজনে টিকটিকি, ইঁদুর, সাপ, পাখির ছানা, বড় কীটপতঙ্গ ইত্যাদি খায়। উচ্চ স্বরে ‘ওয়াং-ওয়াং-ওয়াং’ শব্দে ডাকে।

মার্চ থেকে জুলাই প্রজননকাল। এ সময় ভূমি থেকে কমবেশি ১৫ মিটার উঁচুতে বিশাল ও পুরোনো গাছের কোটরে স্ত্রী পাখি বাসা বানায়। খাদ্য সরবরাহের জন্য ছোট্ট একটি ছিদ্র রেখে পুরুষ পাখি বাইরে থেকে কাদামাটি ও মল দিয়ে বাসার মুখ বন্ধ করে দেয়। স্ত্রী পাখি নির্ধারিত সময়ে একটি–দুটি সাদা ডিম পাড়ে।

কোটরের ভেতরে থেকে ডিমে তা দেয়। পুরুষ এ সময় স্ত্রীকে খাবার খাওয়ায়। ডিম ফোটে ৩৮ থেকে ৪০ দিনে। ছানারা ৫০ থেকে ৯০ দিনে উড়তে শেখে। কোটরে থাকাকালে স্ত্রীর পালক ঝরে পড়ে। পরে আবার পালক গজায় এবং ছানাদের সঙ্গে বাসার বাইরে বেরিয়ে আসে। আয়ুষ্কাল ১৮ থেকে ১৯ বছর।

বন ধ্বংস, বনের পুরোনো গাছ কাটা, চোরা শিকারিদের দৌরাত্ম্য, স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির কারণে দিনে দিনে সংখ্যা কমে গিয়ে বর্তমানে শুধু বান্দরবানের কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে একদিন বইয়ের পাতা ছাড়া আর কোথাও ওদের দেখা যাবে না।

  • আনম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ