টানা দুই দিন বৃষ্টির পর তৃতীয় দিন ঝলমলে রোদে ঘুম ভাঙল। বৃষ্টির কারণে ইতিমধ্যেই নৈনিতাল ভ্রমণের বারোটা বেজে গেছে। বেশির ভাগ সময় খুরপতালের ডাইন্যাস্টি রিসোর্টে শুয়ে-বসে কাটিয়েছি। খুরপতালের অবস্থান ভারতের উত্তরাখন্ডের কুমায়ুনে, নৈনিতাল শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার মিটার উঁচুতে। দুই দিন নৈনিতাল শহর, বাজার, হ্রদ ও চিড়িয়াখানা ছাড়া তেমন কোনো দর্শনীয় স্থানে যেতে পারিনি। কাজেই আজকের দিনটিই ভরসা। নৈনিতালের বাকি জায়গাগুলো দেখে সোজা জিম করবেট চলে যাব।
রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে লাভার্স পয়েন্ট, সুইসাইড পয়েন্ট, নৈনা পিক ও কেভ গার্ডেনে যাওয়ার আগে প্রথমেই আশপাশটা ঘুরে নিলাম। এরপর হিমালয়ান উদ্ভিদ উদ্যানের সাদিয়াতাল জলপ্রপাতের কাছে গাড়ি থামল। দ্রুত জলপ্রপাতের আশপাশ ঘুরে রাস্তার কাছে আসতেই অনিন্দ্যসুন্দর এক প্রজাপতির দেখা পেলাম। কালোর ওপর সবুজ আবির মাখানো ও ডানায় নীল দ্যূতিময় এমন পতঙ্গ জীবনে দেখিনি। অতি চঞ্চল প্রজাপতিটির কয়েকটি ছবি তুলে লাভার্স পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেলাম। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালের ঘটনা এটি।
প্রায় সাত বছর পর পয়লা মার্চ শেরপুর বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. মুগনিউর রহমান মুনি ভাইয়ের আমন্ত্রণে শেরপুরে গেলাম। দ্বিতীয় দিন ঝিনাইগাতি উপজেলার গারো পাহাড়ের রাঙটিয়ায় ঢুকলাম। শালবনের ভেতর ঘণ্টা দেড়েক ঘোরাঘুরি করেও কোনো পাখির দেখা পেলাম না। কাজেই বনের পেছন দিকে গেলাম। এখানে বন বেশ ঘন এবং শালগাছগুলো বেশ উঁচু। মোটরসাইকেল থেকে নামতেই পাখির কলকাকলিতে মনপ্রাণ ভরে গেল। কলকাকলি অনুসরণ করে খানিকটা এগোতেই একটি বিরলসহ কয়েক প্রজাতির পাখির দেখা পেলাম। ওগুলো ছবি তুলে প্রায় সিকি কিলোমিটার পথ হাঁটার পর একটি সর্পিল ছড়ার দেখা মিলল।
ছড়ার পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। বেশিদূর যেতে হলো না। খানিকটা এগোতেই অল্প পানির ছড়াটির পাশে ভেজা বালুর ওপর উড়ন্ত ও বসা অবস্থায় বেশকিছু প্রজাপতি দেখলাম। ওগুলোর ছবি তুলতে গিয়েই ক্যামেরার ফ্রেমে ঢুকে পড়ল নৈনিতালের সেই নীল দ্যূতিময় প্রজাপতিটি! সিলেট বিভাগ ছাড়া এর আগে ওটি দেখার কোনো তথ্য নেই। কাজেই শেরপুরে ওর প্রথম দর্শনে এতটাই বিমোহিত হয়ে পড়লাম যে প্রথম কয়েক মিনিট কোনো ভালো ছবি তুলতে পারলাম না। শেষে এমন অবস্থা হলো যে মুঠোফোন দিয়েও ছবি তোলা গেল।
অনিন্দ্যসুন্দর পতঙ্গটি এদেশের অতি বিরল ও তথ্য অপ্রতুল প্রজাপতি তিতিমৌরাল। এর কোনো বাংলাদেশি নাম নেই, এ নামটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত। ইংরেজি নাম ‘প্যারিস পিকক’। প্যাপিলিওনিডি (চেরালেজি) গোত্রের পতঙ্গটির বৈজ্ঞানিক নাম Papilio paris। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় এগুলোর দেখা মেলে।
তিতিমৌরাল বড় আকারের প্রজাপতি। ডানার বিস্তার ৯০ থেকে ১৪০ মিলিমিটার। কালো ডানার ওপর সোনালি-সবুজ আবির মাখানো। পেছনের ডানার ওপরটায় উজ্জ্বল নীল দ্যূতি রয়েছে, যা পাতি পিকক প্রজাপতি থেকে বড়, বাঁকা ও সুস্পষ্ট। নীল দ্যূতি থেকে এক সারি সবুজ ফুটকি ভূমিকোণের দিকে চলে গেছে। এ রকম সারি সামনের ডানাতেও রয়েছে। লেজ লম্বা। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম হলেও পুরুষের তুলনায় স্ত্রী কিছুটা বড় ও ফ্যাকাশে।
তিতিমৌরাল মিশ্র চিরসবুজ ও পত্রঝরা বনের বাসিন্দা। সচরাচর বনের ছড়া বা স্রোতোধারার পাশে দেখা যায়। দিবাচর প্রজাপতিটি ভালো উড়ুক্কু; উড়তে উড়তে কখনো কখনো মাটির কাছাকাছি চলে আসে। ফুলের রস পছন্দ হলেও স্ত্রী-পুরুষ উভয়ই কাদামাটি ও ভেজা বালুর রস চুষতে পছন্দ করে।
কমলা গুল্ম, সাইট্রাস প্রভৃতি গাছে প্রায় ৬৯ দিনে জীবনচক্র সম্পন্ন করে। স্ত্রী তিতিমৌরাল পোষক গাছের কচি পাতার ডগায় বা পাতার নিচ দিকে পাতাপ্রতি একটি করে ঘিয়ে সাদা গোলাকার ডিম পাড়ে। প্রায় ছয় দিনে ডিম ফুটে সবুজ শূককীট বেরোয়। প্রায় ৪৬ দিন শূককীট থাকার পর এটি নিজেকে মূককীটের সবুজ বা বাদামি শক্ত খোলসে আবৃত করে ফেলে। প্রায় ১৭ দিন পর শূককীটের খোলস কেটে পূর্ণবয়স্ক প্রজাপতি বেরোয়, যা মাত্র দুই সপ্তাহ বাঁচে।