বহু বছর চেষ্টার পর অবশেষে কচিখালী থেকে কটকায় যাওয়ার পথে ছুটা কটকা খালে দেখা পেলাম মহাবিপন্ন সুন্দরী হাঁসের। মনের মতো ছবি তুলে ‘সি-গাল’ নামের ছোট্ট লঞ্চে কটকার পথে এগিয়ে চললাম। পথিমধ্যে খোঁপাবাজ, তিতপোখ ও সংকটাপন্ন মদনটাকের দেখা পেলাম। খানিকটা সামনে এগোতেই একটি খাঁড়ির মুখে দুটি শ্বেতশুভ্র পাখিকে ব্যস্তভাবে মাছ ধরতে দেখলাম। পাখি দুটির একটি ছোট ও অন্যটি বেশ বড়। বহুদিন পর শ্বেতশুভ্র দুটি পাখিকে এক ফ্রেমে ক্লিক করতে পারলাম। ২৭ জানুয়ারি ২০১৮-এর ঘটনা।
এরপর সাড়ে ছয় বছর পার হয়েছে। সম্প্রতি সাইক্লোন রিমালের প্রভাবে বেশ কিছু গভীর সমুদ্রের পাখি দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে ঢুকে পড়েছিল। ওদের ছবি তোলার আশায় এ বছরের পয়লা জুন গিয়েছিলাম মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে। সেতুর আশপাশে ঘোরাঘুরির সময় মাছ ধরার জন্য পাতা জালের ওপর একটি বড় ও অনেকগুলো ছোট শ্বেতশুভ্র পাখিকে মাছ শিকারে ব্যস্ত দেখলাম, সেই সুন্দরবনের পাখি দুটোর মতো।
ছোট ও বড় প্রজাতি ছাড়াও মাঝারি আকারের ওদের আরেক জাতভাই রয়েছে, যদিও সংখ্যায় বেশ কম। এই তিন প্রজাতির শ্বেতশুভ্র পাখিকে একসঙ্গে দেখেছিলাম মুন্সিগঞ্জের পদ্মায় বছর পাঁচেক আগে। আর সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে দেখছি ফি বছর। তবে এক ফ্রেমে তিনটিকে পাইনি কখনো।
শ্বেতশুভ্র এই পাখিগুলো এ দেশের আবাসিক জলচর পাখি তিন প্রজাতির সাদা বগা। বক গোত্রের এই তিন পাখি নিয়েই আজকের ফিচার।
১. বড় বগা: বহুল দৃশ্যমান শ্বেতশুভ্র বগাটির অন্য নাম যাঠুয়া, যাইঠা, বড় সাদা, দাঁড়, ধার, সারস, বড় কোঁরচে বক। ইংরেজি নাম গ্রেট, গ্রেট হোয়াইট, লার্জ, কমন ইগ্রেট বা গ্রেট হেরন। বৈজ্ঞানিক নাম Ardea albus। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। দেহের দৈর্ঘ্য ৯৪ থেকে ১০৪ সেন্টিমিটার এবং ওজন ৯১২ থেকে ১ হাজার ১৪০ গ্রাম।
২. মাঝারি বগা: সচরাচর দৃশ্যমান অথচ এ দেশের সাদা বকগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্লভ আবাসিক এই পাখি খড়ি, কোঁরচে, মাইজলা বক নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম ইন্টারমিডিয়েট, স্মলার, মেডিয়ান, ইয়েলো-বিল্ড, শর্ট-বিল্ড ইগ্রেট। বৈজ্ঞানিক নাম Ardea intermedia। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সব দেশ, এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকায় দেখা যায়। দৈর্ঘ্য ৫৬ থেকে ৭২ সেন্টিমিটার ও ওজন ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম।
৩. ছোট বগা: বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটির অন্য নাম সাদা, ধ–প, ছোট কোঁরচে বক। ইংরেজি নাম লিটল ইগ্রেট। বৈজ্ঞানিক নাম Egretta garzetta। ভারতীয় উপমহাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বহু দেশে দেখা মেলে। দেহের দৈর্ঘ্য ৫৫ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার ও ওজন ৩৫০ থেকে ৫৫০ গ্রাম।
তিন প্রজাতির বগারই পুরো দেহ ধবধবে সাদা। ছোটটি আকারে বাকি দুটির থেকে বেশ ছোট। পা কালো, পায়ের তলা ও আঙুল হলুদ। কিন্তু বড় ও মাঝারি বগার পা, পায়ের পাতা ও আঙুল কালো। বড় বগার লম্বা গলাটি অনেকটা ইংরেজি ‘এস’ আকৃতির, যার মাঝখানটা যেন ভাঙা। বড় আকার, সুস্পষ্ট ভাঙা গলা, লম্বা চঞ্চু, চোখের পেছন পর্যন্ত বিস্তৃত মুখব্যাদান, চ্যাপটা মাথা ইত্যাদির মাধ্যমে মাঝারি বগা থেকে পৃথক করা যায়।
সুন্দরবনসহ পুরো দেশের যেকোনো ধরনের জলাশয়ে ওদের দেখা মেলে। সচরাচর অন্যান্য প্রজাতির বক ও জলচর পাখির মিশ্র দলে বিচরণ করে। অগভীর পানিতে ধীরে ধীরে হেঁটে বা দাঁড়িয়ে শিকার খোঁজে ও ড্যাগারের মতো চোখা চঞ্চুটি দিয়ে ছোট মাছ, ব্যাঙ, কীটপতঙ্গ, ছোট সাপ, চিংড়ি ইত্যাদি শিকার করে খায়। সচরাচর নীরব থাকে। তবে মাঝেমধ্যে বড় বগা নাকিসুরে ‘ক্র্যায়াক...’, মাঝারি বগা ‘ক্রক-ক্রক...’ ও ছোটটি ‘গ্লুক-গ্লুক...’, ‘ক্রু-ক্রু...’ বা ‘ক্রা-ক্রা...’ শব্দে ডাকে।
বড় ও মাঝারি বগার প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মে এবং ছোটটির জুন থেকে সেপ্টেম্বর। সাপ পাখি, পানকৌড়ি ও অন্যান্য জলচর পাখির সঙ্গে একই গাছে উপনিবেশ বাসা তৈরি করে। কাঠিকুটি ও নলখাগড়ার কাণ্ড দিয়ে ঢিলেঢালা বাসা বানায়। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৬টি, রং ফ্যাকাশে নীলাভ-সবুজাভ বা সবুজাভ-নীল। প্রজাতিভেদে ২১ থেকে ২৭ দিনে ডিম ফোটে। স্ত্রী–পুরুষ দুজনেই তা দেয় ও ছানাদের যত্ন করে। ছানারা ৩৫ থেকে ৫০ দিনে উড়তে শেখে ও বাসা ছাড়ে। ছোট ও মাঝারি বগার আয়ুষ্কাল ৬ থেকে ৭ এবং বড়টির ৯ বছরের বেশি।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ