দুই সপ্তাহ ধরে ফেসবুকে একটি পাখির ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পাখিটিকে এখন টক অব দ্য টাউন বলা চলে। দেশের শতাধিক পাখিদেখিয়ে ও আলোকচিত্রী এরই মধ্যে ভিড় করেছেন ঢাকার গুলশানের বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ পার্কে। কেউ অবশ্য খালি হাতে ফেরেননি। প্রায় সবাই পাখিটির ছবি তুলেছেন এবং মনভরে এর দেখা পেয়েছেন। পাখিটির নাম লালবুক চুটকি। অসাধারণ রঙের পরিযায়ী ছোট্ট এক পাখি। এ দেশে পাখিটি খুবই বিরল। এর আগে দেখা মিলেছে মাত্র পাঁচ-ছয়বার। তবে সে সময় লাল রংটা চোখে পড়েনি। দেখা গিয়েছিল স্ত্রী লালবুক চুটকির অথবা অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির। ঢাকা শহরে এবারই প্রথম এ জাতের লাল রঙের পাখির দেখা মিলল।
লালবুক চুটকির দেখা ঢাকায় প্রথম পান আমার পাখিদেখিয়ে বন্ধু ব্রিটিশ পাখিবিজ্ঞানী গ্যারি অলপোর্ট। সেটি ছিল নভেম্বর মাসের প্রথম দিন। সকালে সাহাবুদ্দীন পার্কে পাখি দেখতে গিয়ে এর উপস্থিতি আবিষ্কার করেন তিনি। তারপর পাখিটির ছবি আমাকে পাঠিয়ে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। পাখিটির ছবি দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না। দ্রুতই যাব বলে তাঁকে জানালাম। এরই মধ্যে গ্যারি পাখির ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করলে পাখিদেখিয়েরা ভিড় জমালেন ওই পার্কে।
গত রোববার আমি আর গ্যারি পার্কে হাজির হলাম সকাল–সকাল। পার্কের কর্মীরাও পাখিটির ব্যাপারে এখন বেশ সজাগ। গত কদিনে এত মানুষের ভিড় একটি পাখিকে ঘিরে হবে, তা তাঁরা ভাবতেও পারেননি। মাত্র দুই মিনিটের ভেতর পাখিটির দেখা পেলাম একটি রেইনট্রিগাছে। একসঙ্গে দুটি পাখির (পুরুষ ও নারী) দেখা পেলাম। বেশ খানিকক্ষণ তার ছবি তুললাম আর বাইনোকুলার দিয়ে দেখলাম। একবার হঠাৎ চোখে পড়ল, আরেকটি পাখি এই পাখিকে তাড়া করছে। সেটি ছিল ভিন্ন প্রজাতির আরেকটি চুটকি। নাম তার তাইগা চুটকি।
গ্যারি গত বছরও পাঁচ-ছয়টি তাইগা চুটকি দেখেছিলেন এই পার্কে। মূলত শীতের শুরুতে এ চুটকিটিকে দেখা যায়। ডিসেম্বরের পর এই পাখি অন্য জায়গায় চলে যায়। প্রতিটি চুটকি যে গাছে থাকে তার আশপাশে অন্য চুটকিকে ভিড়তে দেয় না। তারা তাদের এলাকা দখলে রাখতে চায়। অন্য কোনো পাখি ওই গাছে এলে তাড়া করে। এ পার্কে ছয়টি গাছে নিজ নিজ এলাকায় তাইগা চুটকিরা রাজত্ব করছিল। কিন্তু এ বছর হঠাৎ এ পার্কে এসেছে অন্য বিরল প্রজাতির চারটি লালবুক চুটকি। তাইগা চুটকির গাছে যখন এই লালবুক চুটকি আশ্রয় নিচ্ছে, তখনই তাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। লালবুক চুটকি তাই রেইনট্রিগাছের মগডালে থেকে খাবার খুঁজছে।
পনেরো বছর আগে লালবুক চুটকি আর লালগলা চুটকি একই প্রজাতি ছিল। কিন্তু বর্তমানে লালগলা চুটকি আলাদা প্রজাতি হয়ে তাইগা চুটকি নাম ধারণ হয়েছে। লালবুক চুটকির ইংরেজি নাম রেড ব্রেসটেড ফ্লাইক্যাচার। এই প্রজাতি উত্তর–পূর্ব সাইবেরিয়ায় প্রজননকাল সম্পন্ন করে। হয়তো কয়েক সপ্তাহ আগেও এই পাখি তাদের প্রজননভূমিতে ছিল। সেই পাখিই এখন সাহাবুদ্দীন পার্কে। শীতে এগুলোকে দেখা যায় বাংলাদেশসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে।
সাহাবুদ্দীন পার্কে লালবুক চুটকি এখনো আছে। আপনার সন্তানকে নিয়ে বিরল এই পাখি দেখে আসতে পারেন যেকোনো এক সকালে অথবা বিকেলে। এ সময় পাখিটি দেখার ভালো সময়। পাখিটি হয়তো এই পার্কে আরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। তার লাল রঙের বুকখানি আর চটপটে স্বভাব দেখলে সত্যিই আনন্দ পাবেন। পাখিটি দেখতে গিয়ে কেউ তাকে বিরক্ত না করলে হয়তো প্রতিবছরই তার দেখা মিলতে পারে।