প্রতি মাসের শুরুতে আবহাওয়া অধিদপ্তর ওই মাসের আবহাওয়া পরিস্থিতির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস দেয়। চলতি মাসের শুরুতে সেই পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর–মধ্যাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টির কারণেই এ বন্যা হবে বলে জানানো হয়েছিল। এর মধ্যে এখন উত্তর–মধ্যাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে।
সব মিলিয়ে এখন দেশের আট জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব জেলা হলো কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্র আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে জানিয়েছে, বন্যায় দেশের ৮ জেলার ৩৫৭টি ইউনিয়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৪০টি পরিবার। মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ২৯ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন দুজন। একজন ফেনীতে, আরেকজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
এই বন্যার কারণ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, উত্তর–পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রধান সাতটি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মাধ্যমে একটি আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এসব অঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয় ১৬ আগস্ট থেকেই। আর ১৮ আগস্টে সাগরে সৃষ্টি হওয়া লঘুচাপ স্থলে প্রবেশ করে। পরে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলে এসে লঘুচাপ প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। প্রবল বৃষ্টি হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের পার্বত্য অববাহিকাসহ উজানে ভারতের ত্রিপুরা অঞ্চলে।
সরদার উদয় রায়হান বলেন, বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত, সাগরের লঘুচাপ এবং সেই সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে সাগরের জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। সেই কারণে বৃষ্টির পানি নামার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে আমাদের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামের নদীবাহিত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়।
আজ দুপুরের দিকে মৌলভীবাজারের মনু নদের পানি বিপৎসীমার ১১৫ সেন্টিমিটার, হবিগঞ্জে খোয়াই নদ ১৯৫ সেন্টিমিটার, কুমিল্লায় গোমতীর পানি ৭৭ সেন্টিমিটার, ফেনীর পরশুরামে মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের ত্রিপুরায় এবং সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের জেলাগুলোয় ভারী বৃষ্টি হয়েছে বলে জানান উদয় রায়হান। তিনি বলেন, এর ফলে এসব এলাকার নদীর পানি বেড়েছে এবং বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
এই অঞ্চলে অতীতে বন্যার রেকর্ড আছে। কিন্তু এবার বাংলাদেশের এবং উজানে অন্য বছরে তুলনায় বন্যার তীব্রতা বেড়েছে বলে জানান উদয় রায়হান। তিনি বলেন, কিছু কিছু পয়েন্টে নদীর পানি বৃদ্ধি অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। উদাহরণ হিসেবে খোয়াই নদের কথা বলা যায়। এখানে অন্তত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি প্রবাহ দেখা গেছে। শুধু বাংলাদেশেই নদীতে পানির রেকর্ড প্রবাহ হয়নি, উজানেও হয়েছে। মনু নদ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে প্রবাহিত হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার বন্যা তীব্র। আর বন্যার মূল কারণ অতিবৃষ্টি। এর সঙ্গে সাগরে লঘুচাপ এবং পূর্ণিমার উপস্থিতি মিলিয়ে বন্যা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আর পূর্ণিমার কারণে জোয়ারের পানি কমে যাওয়ার প্রবণতা কমে গিয়েছিল।
সরদার উদয় রায়হান বলেন, অতি ভারী বৃষ্টিপাতও বন্যার মূল কারণ। এর সঙ্গে আবার লঘুচাপ, মৌসুমি বায়ু এবং সাগরে জোয়ার—এসব কাজ করেছে।
ভারতের বাঁধের বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তথ্য আদান–প্রদানের ব্যবস্থা নেই বলে জানান উদয় রায়হান। তবে তিনি জানান, দুই উজানের পানি প্রবাহের তথ্য আদান–প্রদান অব্যাহত আছে। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে গোমতী নদীর ত্রিপুরার ওমরপুর পয়েন্টের পানির তথ্যসহ সব নদীর তথ্যই বাংলাদেশ পেয়ে থাকে। তবে বাঁধসংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই।
আগামী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টায় পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হতে পারে বলে মনে করেন প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ এ কে এম নাজমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বন্যা বা জলাবদ্ধতা যা–ই হোক, তা নির্ভর করে উজানে কতটুকু বৃষ্টি হচ্ছে তার ওপর। কয়েক দিন ধরে দেখছি উজানে ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে বৃষ্টিপাত, বন্যা পরিস্থিতিতে তার ৮ থেকে ১০ শতাংশ অবদান থাকে। উজানের ভারী বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যন্তরের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টির কারণে আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী দু–এক দিন উজানে ভারী বর্ষণ হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফেনী বা কুমিল্লা অঞ্চলে ভারী বর্ষণের প্রবণতা আগামীকাল বিকেল থেকে কমে আসতে পারে।