ঘূর্ণিঝড় রিমালে জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২ ফুট।
৮ জেলার ৮০ হাজার ৫৯১ হেক্টর জমি জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়।
৭৩ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে।
ওই এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে দেশের ১৯টি জেলার ৪৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রায় ৪০০ কিলোমিটার আয়তনের ওই ঝড়ের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১২ ফুট। এতে উপকূলীয় এলাকার অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। আর পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার বড় অংশ ভেঙে পড়েছে। এ কারণে স্থানীয় অধিবাসীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি ও কষ্টের মধ্যে পড়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাব নিয়ে এক সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ৩১ মে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা নিয়ে কাজ করা জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত সংস্থা, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় উন্নয়ন সংস্থাগুলো যৌথভাবে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করেছে।
পানি ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এই দুই কারণে স্থানীয় মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ মে শুরু হওয়া ভারী বৃষ্টিপাত ২৭ মে পর্যন্ত ছিল। বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল ও নোয়াখালী জেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়াসহ নানা ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রতিবেদনটি তৈরির দায়িত্বে থাকা সংগঠনগুলোর কো-চেয়ারম্যান কায়সার রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, উপকূলীয় এলাকার জীবন, কৃষি ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা এমনিতেই লবণাক্ততার কারণে সমস্যার মধ্যে ছিল। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ওই সমস্যা আরও বেড়েছে। ফলে জরুরি ভিত্তিতে সেখানে পানি ও স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে হবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে কী করা যায়, সেই কাজের পরিকল্পনা এখনই শুরু করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত ৮ জেলার ২ লাখ ৭৭ হাজার ২২৬ হেক্টর জমির মধ্যে ৮০ হাজার ৫৯১ হেক্টর জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যায়। সেখানকার প্রায় ৪৭ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এর বাইরে স্থানীয়ভাবে মজুত করা ২৩ দশমিক ৫ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয়ে গেছে। পানি ও মাটি লবণাক্ত হওয়ার কারণে মানুষ ও গবাদিপশুর খাদ্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দৈনিক দুর্যোগ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মোট ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ৫ হাজার ৫০০ টন চাল, ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা করে শিশুদের জন্য ও সমপরিমাণ টাকা গবাদিপশুর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর ঘর বানানোর জন্য এ পর্যন্ত ৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য আমরা এখন যে সহায়তাগুলো দিচ্ছি, তা তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর জন্য। দ্রুত আমরা দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু করব।’
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষিজমি ও বাজারের ক্ষতি হওয়ার কারণে ৪৩ শতাংশ মানুষের পক্ষে বাড়িতে ফিরে বাজার ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ৭৩ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে, প্রায় ৭০ শতাংশ গবাদিপশুর খাবার এবং ৮২ শতাংশ মানুষের সুপেয় পানি সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সামগ্রিকভাবে ৯৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জীবিকা এবং আয়-উপার্জন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত ৪২ শতাংশ পরিবার ঝড়ের পর নিজেদের ক্ষতি করে; অর্থাৎ নেতিবাচকভাবে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। ৮৫ শতাংশ পরিবার তাৎক্ষণিকভাবে গবাদিপশু বিক্রি করা এবং খাবার কম খেয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। ৮৬ শতাংশ পরিবার রান্নার জন্য জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারছে না। ফলে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ রান্নার কাজ চালাতে গিয়ে সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। আর ৮৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে। তাদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ কোনো সহায়তা পাচ্ছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন নিয়ে। ভোলা, ঝালকাঠি, পটুয়াখালী, বরগুনা এবং খুলনাবাসী পানি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। ওই এলাকাগুলোর শৌচাগারের ব্যবস্থা এমনিতেই বেশি দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ঝড়ের পর তা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে।
সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ২০ হাজার ২৬০টি পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে দেড় হাজার পুরোপুরি ও বাকিগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চাপকলগুলোর বড় অংশ জোয়ার ও ঝোড়ো বাতাসে নষ্ট হয়ে গেছে।
উপকূলীয় এলাকায় স্বাস্থ্যব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৫০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ১ হাজার ১৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এতে এসব কেন্দ্র ও প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এসব অবকাঠামো এখন পর্যন্ত ব্যবহারের উপযোগী করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, দ্রুত সুপেয় পানির ব্যবস্থা না করলে উপকূলের ওই এলাকাগুলোতে ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়াসহ নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। একই সঙ্গে এসব এলাকায় শুকনা ও প্যাকেটজাত খাবার পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়া মানুষের গবাদিপশু খাদ্য ও অন্যান্য সমস্যার মধ্যে পড়েছে। গবাদিপশুর কথা বিবেচনায় নিতে হবে। এর সঙ্গে জরুরি কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। যেমন বীজ, সার ও অর্থসহায়তা দেওয়া দরকার। অনেকের জন্য বাড়িঘর তৈরির উপকরণ প্রয়োজন।