ঢাকা শহরে এ প্রজাতির মাত্র তিনটি গাছ দেখেছি। দুটি গাছ ধানমন্ডি লেকের পাড়ে, অন্যটি শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। গাছটি বেশ বড়। তখন বর্ষাকাল। মাটি, পাতা, গাছ—সবই ভেজা। ধানমন্ডি লেকের পাড়ের গাছ দুটির গোড়া থেকে মাটি সরে যাওয়ায় শিকড় বেরিয়ে পড়েছে। ভার সইতে না পেরে গাছ দুটি হেলে পড়েছে। কাণ্ড থেকে সরু সরু সেমাইয়ের মতো অসংখ্য শিকড় বেরিয়েছে, অনেকটা বটের ঝুরির মতো, তবে সেগুলো সুতার মতো চিকন।
কিন্তু পাতা কিছুতেই বটের মতো নয়, বরং গোলাপজামের মতো লম্বাটে ও চিকন। ছবি তুলে নিয়ে এলাম অচিন গাছ দুটির। পাতা, কাণ্ড, শিকড়—সবকিছুরই ছবি তুললাম। ফুল-ফল নেই গাছ দুটির যে তা দেখে চেনার সহায়তা পাওয়া যাবে। ছবি তুলে পাঠালাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ গবেষক আব্দুর রহিমের কাছে। পাশাপাশি বইপত্র ও ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বইয়ের নবম খণ্ডের ২২৬ পৃষ্ঠার একটি ছবি দেখে মনে হলো, এটিই হয়তো সেই গাছ। বইয়ের বর্ণনামতো তার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম পেলাম Ficus maclellandii, ইংরেজি নাম পেলাম Narrow Leaf Fig ev Long leaf fig। ভাসকুলার ফ্লোরা অব চিটাগং অ্যান্ড দ্য চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস বইয়ে এ গাছের স্থানীয় নাম পেলাম চিকনাপাতা ডুমুর। ১৯০৪ সালে চট্টগ্রামে এ গাছের সন্ধান মিলেছিল। বর্তমানে প্রাকৃতিকভাবে আর এ গাছ কোথাও জন্মাতে দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আব্দুর রহিমকে এই উদ্ভিদতাত্ত্বিক নামটাই পাঠিয়ে দিলাম। তিনিও তা নিশ্চিত করলেন।
এ গাছের ইংরেজি নামের সরলার্থ করলে ও পাতার বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলে এর বাংলা নাম ‘চিকনাপাতা ডুমুর’ যথার্থ। বছরখানেক আগে এরই একটি ছোট চারা গাছ দেখেছিলাম আশুলিয়ায় চারাবাগে বরিশাল নার্সারিতে। তখন শীতকাল। সে গাছে কয়েকটি ডুমুরের মতো লাল-বেগুনি ফল ধরেছিল। নার্সারির মালি জানিয়েছিলেন, গাছটি তাঁরা এনেছেন থাইল্যান্ড থেকে। সঠিক নাম জানেন না, মনগড়া একটা নাম বলেছিলেন, বিদ্ঘুটে সে নাম এখন আর মনে করতে পারলাম না। তাঁরা এর ছোট চারাকে টবে লাগানোর জন্য বাহারি গাছ হিসেবে বিক্রি করেন বলে জানান। গাছকে ছেঁটে ছেঁটে ছোট করে কয়েক বছর বড় টবে বা ড্রামে রাখা যায়। নার্সারিতে গাছটি থাইল্যান্ড থেকে এলেও আসলে এ গাছের আদিনিবাস ভারতবর্ষ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া। সে অর্থে এটি আমাদের দেশি গাছ।
চিকনাপাতা ডুমুর মাঝারি আকারের চিরসবুজ বৃক্ষ, গাছ ২৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছ অর্ধপরাশ্রয়ী বা স্থলজ, বাকল ধূসর থেকে কালচে বাদামি, মসৃণ, ডাল বা কাণ্ডÐ থেকে সরু সুতার মতো ঝুলন্ত শিকড় জন্মে। পাতা সরু, লম্বা, মসৃণ, ওপরের পিঠ চকচকে, অগ্রভাগ সুচালো ও দীর্ঘাগ্র। শাখা-প্রশাখার দুই পাশে বিপরীতক্রমে পাতা সজ্জিত থাকে। বোঁটা খাটো, মধ্যশিরা স্পষ্ট। পাতা ৮ থেকে ১৩ সেন্টিমিটার লম্বা। তবে দুই রকম চেহারার পাতা দেখা যায়। নিচের দিকে থাকা তরুণ প্রশাখায় জন্মানো পাতাগুলো অপেক্ষাকৃত সরু ও লম্বা, ওপরের দিকে বয়স্ক ডালে জন্মানো পাতাগুলো কিছুটা চওড়া। পাতাই এ প্রজাতি শনাক্তকরণের অন্যতম উপায়। পত্রবহুল উপশাখায় পাতার কোল থেকে ডুমুর জন্মে, পরিণত অবস্থায় তার রং বেগুনি লাল। সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ফল ধরে। অরণ্য, জলাশয় বা খালের পাড়ে ও সমতল ভূমিতে এ গাছ জন্মে। বাংলাদেশে এ প্রজাতির গাছ চট্টগ্রাম থেকে নথিভুক্ত করা হয়েছিল। পরে আর এর খোঁজ মেলেনি। এ গাছের কাঠ জ্বালানি ছাড়া আর কোনো কাজে লাগে না। বীজ দ্বারা বংশবিস্তার ঘটে। ডাল কেটে লাগিয়ে বংশবিস্তারের পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
মোরেসি গোত্রের এ গাছ যে অতি বিরল, তা জানা যায় বাংলাদেশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ বই থেকে। বইটিতে এ প্রজাতির গাছ সংরক্ষণের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ প্রজাতির গাছ যদি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তার সেই আবাসস্থলেই তাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, পাশাপাশি স্ব-স্থানে এবং স্ব-স্থানের বাইরে সে গাছ সংরক্ষণের চেষ্টা করতে হবে। ঢাকা শহরে থাকা এ তিনটি গাছ নিয়ে আরও গবেষণা ও পুনরায় অনুসন্ধান চালানো উচিত, সংরক্ষণের উদ্যোগও নিতে হবে।