নীলফামারী জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে শতবর্ষী কাঠগোলাপগাছ
নীলফামারী জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে শতবর্ষী কাঠগোলাপগাছ

রূপ ছড়াচ্ছে কাঠগোলাপ

আদালত মানেই বটতলা বলে যে কথা প্রচলিত আছে, তা সব ক্ষেত্রে সত্য, এমনটা নয়। নীলফামারী জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে রূপ ছড়াচ্ছে শতবর্ষী একটি কাঠগোলাপগাছ। থোকায় থোকায় ধবধবে সাদা রঙের পাপড়ির মধ্যে গাঢ় হলুদাভ এই ফুলের সুবাস এখন পুরো আদালতপাড়ায়।

মূল আদালত ভবন লাগোয়া সদ্য নির্মিত বিচারপ্রার্থী মানুষের বিশ্রামের জন্য ‘ন্যায়কুঞ্জ’ ভবন। এ ভবনের ঠিক সামনে আদালতের বারান্দা ঘেঁষে কাঠগোলাপের গাছটি অনেক দিনের পুরোনো।

গত বছর ন্যায়কুঞ্জ ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা অনুযায়ী গাছটি কাটা পড়ার কথা। কিন্তু জেলা জজ মাহমুদুল করিম ন্যায়কুঞ্জ ভবনের দিক পরিবর্তন করে গাছটিকে বাঁচিয়েছিলেন।

গাছটির বয়স কত হবে, তা সঠিক কেউ জানে না। তবে শতবর্ষী, এটা নিয়ে সন্দেহ নেই কারও মনে। আলাপচারিতায় জেলার প্রবীণ আইনজীবী তুষার কান্তি রায় বলেন, আইন পেশার শুরু থেকেই তিনি গাছটি দেখে আসছেন ঠিক এভাবেই। আরও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরাও এভাবেই দেখেছেন গাছটিকে।

বয়স যা–ই হোক, তার রূপ কমেনি একটুও।

নিখাদ কাঠগোলাপপ্রেমী ছাড়াও কাঠগোলাপের রূপে মজেনি, সম্ভবত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। গোলাপের পক্ষ নিয়ে যত কথাই বলা হোক না কেন, রূপবৈশিষ্ট্য, সুরভি ও স্বাতন্ত্র্যবোধে কাঠগোলাপের রয়েছে নিজস্বতা। সাদা পাপড়ির মধ্যে গাঢ় হলুদের ছোঁয়ালাগা এই ফুলকে সবাই পছন্দ করে।

তাই এই বৃক্ষতল মাড়ানোর সময় না থমকে পারা যায় না। কাঠগোলাপের সঙ্গে শিউলি ফুলের বেশ মিল রয়েছে। বিশেষ করে পাপড়ির রং ও আভা। তা ছাড়া ঝরে পড়ার সময় উভয় ফুলের বৃন্তই ওপরের দিকে থাকে। শিউলি ফুল নিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘শিউলিতলায় ভোরবেলায় কুসুম কুড়ায় পল্লী–বালা, শেফালি পুলকে ঝ’রে পড়ে মুখে খোঁপাতে চিবুকে আবেশ-উতালা’ বেশ জনপ্রিয়। এই গানে মূলত শিউলির সঙ্গে জড়িয়ে শিউলি কুড়ানো পল্লী–বালার রূপকেই তুলে ধরা হয়েছে বেশি। কবি কাঠগোলাপকে নিয়ে গান না লিখলেও কাঠগোলাপের রূপে যে মজেছিলেন, তা জানা যায়।

অনেকেই কাঠগোলাপের শুভ্র রুক্ষতা নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তা কেবল সাময়িক। শীতের রুক্ষতায় কাঠগোলাপ যখন অবগুণ্ঠন খোলে, তখন অন্যান্য বৃক্ষের চেয়ে পত্রপল্লব ছাড়া কাঠগোলাপের শরীর উপমাহীন সুন্দর মনে হয়।

গোলাপ, না কাঠগোলাপ—এই দ্বন্দ্ব প্রকট না হলেও প্রচ্ছন্ন আকারে চলছে ফুলপ্রেমীদের মধ্যে। এদিক দিয়ে কাঠগোলাপের পক্ষ আবার এককাঠি সরেস। তাঁদের দাবি:

‘গোলাপ নয় বরং তোমার খোঁপায় কাঠগোলাপ শোভাবর্ধন করুক।’

কেউ কেউ মনে করেন, কাঠগোলাপের মতো এত সুন্দর ফুল আর পৃথিবীতে হয় না।

কাঠগোলাপের সৌন্দর্যের সঙ্গে তার মনকাড়া সুবাসও কিন্তু কম নয়। সন্ধ্যারাতে ছড়ানো সুবাসের আড়ালে লুক্কায়িত প্রেয়সীর মতো সে কাছে টানবেই।

বৃষ্টিস্নাত কাঠগোলাপ আরও অনন্য, আরও রূপময়। কাঠগোলাপের এই বৃষ্টিস্নানের সঙ্গে বাঙালি রমণীর কোথায় যেন মিল রয়েছে!

বিদেশি এই ফুল দীর্ঘদিনের সখ্যে এ দেশের আলো, জল আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে অনেক আগেই। আমি গোলাপ-কাঠগোলাপের দ্বন্দ্বে না জড়ালেও আদালতের খাসকামরা থেকে কাঠগোলাপের দিকে অপলক চেয়ে থাকি আনমনে। মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে ভাবি কাউকে আকর্ষণ করার কী যে এক দুর্লভ ক্ষমতা এই ফুলের।

এই সময় নীলফামারী জেলা জজ আদালতের আঙিনাজুড়ে কাঠগোলাপের রাজত্ব। বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী কে না মজেছে এর সুবাসে! এ যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি।

  • লেখক, যুগ্ম জেলা জজ, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল, নীলফামারী