বন্যার পানি পুরোপুরি সরে গেলে এসব গাছের পরিচর্যা দরকার হবে। সম্প্রতি ফেনী শহরের ট্রাঙ্ক রোডে
বন্যার পানি পুরোপুরি সরে গেলে এসব গাছের পরিচর্যা দরকার হবে। সম্প্রতি ফেনী শহরের ট্রাঙ্ক রোডে

আশ্রয়হীন গাছেরাই অন্যদের আশ্রয়

মানুষের মতো গাছেদের তো হাত-পা নেই যে তারা হেঁটে হেঁটে চলে যাবে পাহাড়ের ঢালে বা সাঁতরে চলে যাবে কোনো আশ্রয়স্থলে। পাতাগুলো পাখির ডানা নয় যে জল হলে উড়ে যাবে আকাশে। তাই বানের জলে আকণ্ঠ ডুবে আশ্রয়হীন বৃক্ষদের অপেক্ষা করতে হয় সুসময়ের জন্য—কখন নামবে বন্যার পানি।

ফেনীর বন্যায় এবার অনেক স্থানে ঘরের চাল পর্যন্ত বন্যার পানি উঠে গেছে। বাড়িতে থাকার কোনো উপায় নেই। অগত্যা কলাগাছের ভেলায় করে ভেসে ভেসে মানুষ চলেছে আশ্রয়কেন্দ্রের খোঁজ। সঙ্গে পোষা প্রাণীকে নিয়েছে। বানের তীব্র স্রোতের টান থেকে বাঁচতে অসহায় মানুষেরা শক্ত করে ধরে রেখেছে বড় বড় গাছের ডাল। অনেক বন্য প্রাণীকেও আশ্রয় দিয়েছে গাছ। বিশেষ করে পাখি, সাপ, বেজি, গুইসাপ ইত্যাদি প্রাণী ঠাঁই পেয়েছে বৃক্ষদের কোলে।

তবে ধান, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল, যেগুলো তলিয়ে গেছে, সে ক্ষতি আর পূরণের নয়। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের এ বছর হয়তো হেমন্তে আর নবীন ধান্যে হবে না নবান্ন। খেতে ফলবে না খই-মুড়ির ধান।

এমনকি ইঁদুরের মতো গর্তবাসী খুদে প্রাণীরাও বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে ভাসমান সামান্য খড়কুটো বা নারকেলপাতার আগা ধরে। যেসব পোকার ডানা আছে, তারাই-বা কতটুকু নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পেরেছে? ঝোপঝাড় যেখানে যতটুকু পাওয়া গেছে, সেখানে আশ্রয় জুটেছে তাদের। তবে এবারের বন্যায় ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি তৃণলতা, গুল্ম, বীরুৎ তথা ছোট ছোট গাছের। আগাছা, ঘাস, লতা—না জানি কত জীবের কতকালের আবাসস্থল ছিল! সেসব বাস্তুতন্ত্র একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। আগাছার তুলনামূলকভাবে ধকল সইবার ক্ষমতা বেশি, পাকা বীজগুলোও বানের পানিতে ভেসে দূরে গিয়ে হয়তো আবার গজাতে পারে, গড়তে পারে নতুন আবাস। যেখানে তারা ছিল সেখানে বানের পানিতে কয়েক দিন ডুবে ফুল, ফল, লতা, পাতা পচে গেছে। তাতে কি, হলদে মুথা আর কাকপায়া, কিংবা শারদ শুভ্র ফুলের কাশগাছ—এসব ঠিকই আবার মাটির নিচে থাকা মোথা ও শিকড় থেকে নবীন কচি সবুজ রং মেখে জলশুকানো মাটির বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবে, মানুষকে বলবে—ওহে মানুষেরা, দেখো, দুর্যোগ এলেও ভেঙে পড়তে নেই। এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, জীবনের কোনো শেষ নেই। এক জীবন থেকে অন্য জীবনে যেতে হয়, থেমে থাকতে নেই। ঠিকই ওদের মতো নিশ্চয়ই বন্যার পর আবার জেগে উঠবে ওসব এলাকার মুক্তাঝুরি, ধুতরা, কালকাসুন্দা, মটমটি, বিষকাটালি, হাতিশুঁড়, দ্বন্দ্বকলস, অপাং, দাদমর্দন গাছেরা। এই শরতেই এ গাছগুলোয় নিশ্চয়ই ফুটবে ফুল, ধরবে ফল—আবার মাটির বুক সবুজ হবে সেসব লতাগুল্ম-বীরুতে। তবে ধান, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল, যেগুলো তলিয়ে গেছে, সে ক্ষতি আর পূরণের নয়। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের এ বছর হয়তো হেমন্তে আর নবীন ধান্যে হবে না নবান্ন। খেতে ফলবে না খই-মুড়ির ধান।

এ তো গেল ছোট গাছেদের কথা। এবার বলি বড় গাছেদের কথা, যাদের আমরা বৃক্ষ বলি।

গণমাধ্যমে যখন বন্যাকবলিত এলাকার ছবি, বিশেষ করে ড্রোন ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলো দেখি তখন দিকচিহ্নহীন ঘোলাটে স্রোতময় পানির মধ্যে কেবল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি চম্বল, ইউক্যালিপটাস, মেহগনি, রেইনট্রি, ছাতিম, বাবলাগাছদের। আম, জাম, কাঁঠাল ইত্যাদি বড় গাছ পানিতে ডুবে নির্জীব হয়ে আছে, এগুলোর অনেক গাছই হয়তো পানি শুকিয়ে গেলে নিজেরাও শুকিয়ে যাবে। বিশেষ করে কাঁঠাল। কলা ও পেঁপে তো বাঁচবেই না। যেসব গাছ স্রোতের তোড়ে হেলে বা ভেঙে গেছে, সেগুলোও আছে ঝুঁকিতে। পলিজমা পাতারা ঝরে যাবে।

এই শরতেই এ গাছগুলোয় নিশ্চয়ই ফুটবে ফুল, ধরবে ফল—আবার মাটির বুক সবুজ হবে সেসব লতাগুল্ম-বীরুতে। তবে ধান, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসল, যেগুলো তলিয়ে গেছে, সে ক্ষতি আর পূরণের নয়। বন্যাকবলিত এলাকার মানুষদের এ বছর হয়তো হেমন্তে আর নবীন ধান্যে হবে না নবান্ন। খেতে ফলবে না খই-মুড়ির ধান।

ওপর থেকে তোলা ছবি দেখে আর একটি কথা মনে এল, বানের অল্প পানিতেও যেখানে রাস্তা দৃশ্যমান না, সেখানে রাস্তার দুপাশে সার করে লাগানো বৃক্ষেরা যেন সেসব রাস্তার দিকপাল।

বানের পানি দ্রুত সরে যাবে। কিন্তু ওসব এলাকার মানুষরা এত দিন যেসব গাছের আশ্রয় ও ছায়ায় ছিল, তা হয়তো সেভাবে থাকবে না। কিন্তু তা থাকাটা খুব জরুরি। বন্যার পর তাই এসব গাছের পরিচর্যা করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হবে, নতুন করেও গাছ লাগিয়ে শূন্যস্থান পূর্ণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমরা না থাকলেও গাছেরা বেঁচে থাকবে, কিন্তু গাছেরা না থাকলে আমরা বেঁচে থাকব না।