বাংলাদেশে চাতক গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি
বাংলাদেশে চাতক গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি

প্রতীক্ষার চাতক ডাকছে না, বেড়েছে বৃষ্টির অপেক্ষা

‘মৌসুমি পাখি দেখা গেছে, হয়তো বৃষ্টি আসছে’। দক্ষিণ ভারতীয় ইংরেজি গণমাধ্যম ডেকান ক্রনিকলের গত মে মাসের শেষ দিনের এক প্রতিবেদনের শিরোনাম এটি। এখানে লেখা আছে, এরপরই কৃষক মাটিতে বীজ বুনতে জমি চাষের প্রস্তুতি নেবেন। অর্থাৎ একটি পাখির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে আবহাওয়া ও ফসলের মাঠের।

প্রতিবেদনের ‘মনসুন বার্ড’ বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়া পাখিটি বাংলার ‘চাতক’। সংস্কৃততেও এ পাখিকে চাতক নামেই ডাকা হয়। তেলেঙ্গানা রাজ্যের জহিরাবাদ এলাকায় এ বছর প্রথমবারের মতো চাতক পাখিকে দেখে লেখা হয়েছে ‘মুনসুন বার্ড স্পটেড, রেইনস অন দেয়ার ওয়ে’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি।

পাখি দর্শনের সঙ্গে মেঘ-বৃষ্টির সম্পর্কের কথা বাংলার লালন ফকিরের সুরে সুরে এসেছে আরও কত আগে। তিনি তাই লম্বা লেজওয়ালা কালোরঙা অতি চঞ্চল এ পাখি নিয়ে প্রশ্ন রাখলেন, ‘অমৃত মেঘের বারি মুখের কথায় কি মেলে?/ চাতক স্বভাব না হলে।’

প্রতীক্ষার রূপক হিসেবে উপমা পায় চাতক। এই উপমা সম্ভবত তৈরি হয়েছিল একটি সংস্কৃত লোককাহিনি থেকে। এ কাহিনি মা আর ছেলের গল্প। এক অসুস্থ মা তার ছেলের কাছে কাতর স্বরে পানি খেতে চেয়েছিল। ছেলে খেয়াল করেনি। মা সেই কাতরতা নিয়েই মারা যায়। মায়ের মৃত্যু বুঝতে পেরে ছেলে অনুশোচনায় নুয়ে গেল, কাতর হলো। তখন সে পানি পানি করে চিৎকার করতে করতে প্রার্থনা করল, স্বর্গে গিয়ে মাকে পানি দিয়ে আসতে চায়। কিন্তু স্বর্গে তো চাইলেই যাওয়া যাবে না, তখন তাকে বানিয়ে দেওয়া হলো এক পাখি।

কী সেই চাতকের স্বভাব

বাংলাদেশে চাতক গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি। বিশ্বাস করা হয়, এ পাখির সঙ্গে আসে অমৃত মেঘের পানি। বহুদূর থেকে উড়ে আসা খুব কোলাহলপ্রিয়, লোকালয়ে নির্ভীক চাতক একসময় ছিল খুব চেনা পাখি। যেন গ্রীষ্মে সে ঘরের পাশের গাছটিতে বসে পিউ পিউ স্বরে ডাকবে—এটাই স্বাভাবিক। আর ছিল তাকে নিয়ে বহু গল্প। কৃষকেরা বলতেন, এ পাখি দেখলে মেঘ নেমে আসে। এতটা জনপ্রিয় চাতক এখন আর লোকালয়ে বিশেষ দেখা যায় না।

পাখি-গবেষকেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রভাব ফেলছে মানুষের স্বার্থপর আচরণ। পাখির নির্বিঘ্ন আবাসস্থল থাকছে না। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারে মরে যাচ্ছে পোকা। ফুরিয়ে যাচ্ছে পাখির খাবার। তাই গ্রীষ্মের পরিযায়ী চাতক যদিও-বা উড়ে আসে দূর থেকে, তাকে আর পাওয়া যায় না ঘরের পাশে অথবা বাগানে, মানুষের কাছাকাছি।

গ্রীষ্মকালে পরিযায়ী হিসেবে জ্যাকোবিন কুক্কো আর চেস্টনাট উইন্ড কুক্কো নামে কোকিল গোত্রের যে দুটি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে আসে, তাদেরই ডাকা হয় চাতক বলে। ওরা সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে আসতে শুরু করে। আবার জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে চলে যায়। এই পাখিকে একসময় মানুষের ঘরের কাছেই দেখা যেত। এখন মধুপুর, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়ায় পাওয়া যাবে।
মো. কামরুল হাসান, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ঘরের কাছেই আসত চাতক

চাতক মূলত কোকিল প্রজাতির একটি গোত্র। পাপিয়া ও পাকড়া পাপিয়া নামেও ডাকা হয় চাতককে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রীষ্মকালে পরিযায়ী হিসেবে জ্যাকোবিন কুক্কো আর চেস্টনাট উইন্ড কুক্কো নামে কোকিল গোত্রের যে দুটি প্রজাতির পাখি বাংলাদেশে আসে, তাদেরই ডাকা হয় চাতক বলে। ওরা সাধারণত মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে আসতে শুরু করে। আবার জুন থেকে জুলাইয়ের মধ্যে চলে যায়। এ পাখিকে একসময় মানুষের ঘরের কাছেই দেখা যেত। এখন মধুপুর, সাতছড়ি ও লাউয়াছড়ায় পাওয়া যাবে।’

বন্য প্রাণী ও পাখি বিষয়ের এই গবেষক আরও বলেন, চাতকের ডাক শোনা গেলে বৃষ্টি আসবে—এটি মানুষের লৌকিক বিশ্বাস। আদতে ওটা পাখির প্রজননকালের ডাক। এ পাখি নিজে বাসা বাঁধে না। ডিম পাড়ে অন্য পাখির বাসায়।

ভারতের বায়োডাইভারসিটি হেরিটেজ লাইব্রেরির অনলাইন পাঠাগারে চাতকের পরিযায়ী ভ্রমণ নিয়ে প্রখ্যাত ব্রিটিশ পাখিবিশারদ হিউ হুইসলারের লেখা প্রবন্ধ আছে। ১৯২৮ সালে লেখা এ প্রবন্ধে হুইসলার বলেছেন, ভারতের গ্রীষ্মকালীন কোকিল গোত্রের পাখিগুলো শীতকাল এলে আরব মহাসাগরের পথ ধরে উড়ে চলে যায় আফ্রিকার দিকে। কিন্তু যখন ওরা এই লোকালয়ে থাকে, তখন ওদের দেখতে পাওয়া যায় যেকোনো জায়গায়।

শত বছর আগে লেখা প্রবন্ধেও চাতককে উল্লেখ করা হয়েছে বৃষ্টির পাখি হিসেবে। ওড়ার সময় এদের ডানা ও লেজের সাদা অংশ সহজেই দেখা যায়। তবে ছোট চাতকের বুকের রং সাদার পরিবর্তে কিছুটা লালচে আভার হয়। হুইসলারের লেখায় পাওয়া যায়, সেই শত বছর আগেও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করে রাখা পাখির মধ্যে রয়েছে এ পাখির শরীরের সে তথ্য।

চাতক কমছে লোকালয় থেকে

‘স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস বার্ডস’ বা ‘বিশ্বের পাখি পরিস্থিতি’ নিয়ে ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, পৃথিবীর প্রায় ৪৮ শতাংশ পাখি প্রজাতি বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকিতে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ জরিপে আলাদা করে চাতকের কথা উল্লেখ নেই। তবে যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত পাখিবিষয়ক ওয়েবসাইট বিওইউর ২০২০ সালের মার্চে ‘ডিকলাইন অব দ্য কুক্কো’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যে কমন কুক্কো (ব্রিটিশ উচ্চারণ) বা কোকিল প্রজাতির পাখি ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। চাতক এই কুক্কো (ব্রিটিশ উচ্চারণ) প্রজাতির পাখি।

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সভাপতি ইনাম আল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘চাতক কমেছে নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালের পরিযায়ী এ পাখিদের ৯০ শতাংশই পোকা খায়। দেশে গত ২৫ বছরে ৫০ শতাংশ পোকা কমেছে। বড় কারণ অতি মাত্রায় কীটনাশকের ব্যবহার। এ পাখির এখন খাবারসংকট হচ্ছে। গাছপালা কেটে ফেলায়, বাঁশঝাড় না থাকায় এখন লোকালয়ে থাকতে সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না।’

এই পাখিবিশেষজ্ঞ আরও বলেন, শীতের পাখি অধিকাংশ জলচর বলে গোনা যায় সহজে। গ্রীষ্মের পরিযায়ী পাখি নিয়ে জরিপ নেই। গ্রীষ্মের পাখির জরিপ শ্রম ও ব্যয়সাপেক্ষ। বাংলাদেশে পাখি নিয়ে গবেষণাকাজ দুর্বল বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

ইনাম আল হকের মতে, চাতক নিয়ে যেসব রূপকথা মানুষ বিশ্বাস করে, এর অধিকাংশই লৌকিক বিশ্বাস। পরিযায়ী ছোট্ট চাতক বৃষ্টির পানি ছাড়াও যেকোনো জায়গা থেকেই পানি খায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশে চাতক গ্রীষ্মকালীন পরিযায়ী পাখি।

চাতক নিয়ে আছে অনেক গল্প

প্রতীক্ষার রূপক হিসেবে উপমা পায় চাতক। এ উপমা সম্ভবত তৈরি হয়েছিল একটি সংস্কৃত লোককাহিনি থেকে। এ কাহিনি মা আর ছেলের গল্প। এক অসুস্থ মা তার ছেলের কাছে কাতর স্বরে পানি খেতে চেয়েছিল। ছেলে খেয়াল করেনি। মা সেই কাতরতা নিয়েই মারা যায়। মায়ের মৃত্যু বুঝতে পেরে ছেলে অনুশোচনায় নুয়ে গেল, কাতর হলো। তখন সে পানি পানি করে চিৎকার করতে করতে প্রার্থনা করল, স্বর্গে গিয়ে মাকে পানি দিয়ে আসতে চায়। কিন্তু স্বর্গে তো চাইলেই যাওয়া যাবে না, তখন তাকে বানিয়ে দেওয়া হলো এক পাখি। আর পাখি হয়ে যাওয়া সেই ছেলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, মায়ের মুখে পানি দেওয়ার আগে সে নিজের মুখে পানি দেবে না। তখন থেকে শুরু হলো তার বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা।

বৃষ্টির প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে থাকা মানুষের মতো চাতকও এক প্রাণ। যে ছোট্ট প্রাণটির উপস্থিতি আমাদের আনন্দ দিয়েছে, সাহিত্যে জল সিঞ্চন করেছে, আজ যখন আর তাকে লোকালয়ে দেখা যায় না, তখন সে মূল্যহীনও বটে। লোকালয় নিয়ে এক সামান্য পাখির স্বভাব বদলে কী আর আসে-যায়!

চাতক নিয়ে লোককথাটি সংস্কৃত ভাষায়ও বর্ণিত হয়েছে। তাই ধারণা করা হয়, চাতকের এমন চাতক হয়ে ওঠার গল্প বহুকালের পুরোনো। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ঘুরে সে নানা রূপ পেয়েছে। তবে বৃষ্টির সঙ্গে এ পাখির সম্পর্ক কত দৃঢ়, তা বোঝা যায় কৃষিকাজ করা অনেক মানুষের বিশ্বাস থেকে। কোনো কোনো অঞ্চলে যেমন বৃষ্টি ডাকতে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়া হয়, তেমনি খড়কুটো দিয়ে চাতক পাখি বানিয়ে ফসলের খেতে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে দেওয়ার রীতিও দেখা যায়। তারা বিশ্বাস করে, চাতক পাখিকে দেখে মেঘ আসবে আরও নিচু হয়ে। মেঘের সঙ্গে চাতকের এ সম্পর্ক তো আজকের নয়।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে ও মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’-এ পাওয়া যায় চাতকের কথা। কালিদাস লিখছেন, অনুকূল বাতাস ধীরে ধীরে যখন বয়ে যায়, তখন যা যা ঘটে, এর মধ্যে রয়েছে চাতকের কথা বলা বা ডাক শোনার উপমা। তবে অনুকূল বাতাস বলতে তিনি বর্ষাকালকেই বুঝিয়েছেন কি না, তা জানতে হলে পুরো ‘মেঘদূত’ পড়ে বলতে হবে।

পাপিয়া নামে পরিচিত চাতক মুগ্ধ করেছিল কাজী নজরুল ইসলামকে। তাঁর গানে তাই উঠে এল পাপিয়ার কথা বারবার।

তবে চাতকের প্রতি বিস্ময়ে লালনের কথাগুলোই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি চাতক চিনিয়েছে আমাদের—‘চাতক পাখির এমনি ধারা/ তৃষ্ণায় জীবন যায় গো মারা।/ অন্য বারি খায় না তারা/ মেঘের জল বিনে।’

আষাঢ়ের প্রথম দিন আজ। দুই দিন আগেই বৃষ্টি এল। কিন্তু চাতক কোথায়?