২০১৬ সালের পর ২০২৩ সালে ঢাকার বায়ুমান সবচেয়ে খারাপ ছিল। গতকাল রাতেও ঢাকা ছিল শীর্ষ দূষিত শহর।
ঢাকায় বায়ুদূষণ বাড়ছেই। ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বায়ুমান সূচকে ঢাকার গড় নম্বর (স্কোর) ছিল ১৭১, যা আগের বছর ছিল ১৬৩।
বায়ুমান সূচকে নম্বর ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে গণ্য হয়। নম্বর যত বেশি হবে, মান তত খারাপ।
ঢাকায় বায়ুমানের এই অবনতির মাশুল দিতে হচ্ছে মানুষকে। রাজধানীবাসীর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও প্রবীণেরা ভুগছেন বেশি। চিকিৎসার জন্য বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যা চড়া মূল্যস্ফীতির মধ্যে সংসারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা সায়মা ইসলাম নিজের শিশুসন্তানকে নিয়ে গত সোমবার গিয়েছিলেন ধানমন্ডিতে একজন চিকিৎসকের কাছে। তাঁর সন্তানের কাঁশি লেগেই থাকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক বলেছেন তাঁর সন্তানের রক্তে অ্যালার্জির মাত্রা অনেক বেশি, যেটার কারণ বায়ুদূষণ।
সায়মা জানান, ওই দিন চিকিৎসকের পরামর্শ ফি ও অটোরিকশার ভাড়ায় তাঁর ব্যয় হয়েছে দুই হাজার টাকা। রোগ পরীক্ষার ফি ৬৫০ টাকা। চিকিৎসক যে ওষুধ দিয়েছেন, তাতে দিনে দেড় শ টাকা করে এক মাসে সাড়ে চার হাজার টাকা ব্যয় হবে। সর্বমোট ব্যয় সাত হাজার টাকার বেশি। তিনি বলেন, ‘ঢাকা ছাড়তে পারলে বাঁচতাম। ছেলেটার কষ্ট আর সহ্য হয় না।’
নতুন বছর (২০২৪) শুরু হয়েছে গত সোমবার। ওই দিন সকালে বিশ্বের ১০৯টি শহরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর ছিল ঢাকা। গতকাল মঙ্গলবারও বায়ুদূষণে ঢাকাই ছিল সবার ওপরে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুমান সূচকে গতকাল রাত ৯টায় ঢাকার নম্বর ছিল ২৮১, অর্থাৎ ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’। শীর্ষ পাঁচে এরপর ছিল ভারতের দিল্লি, কলকাতা, পাকিস্তানের লাহোর ও চীনের শেনইয়াং।
বায়ুমান সূচকে ছয়টি শ্রেণি রয়েছে। নম্বরের ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিগুলো নির্ধারিত হয়। ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণাই (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। নম্বর নির্ধারিত হয় অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে।
আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো শহরের নম্বর ৫০ বা তার কম হলে বায়ুর মান ভালো বলে ধরা হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’, ১০১ থেকে ১৫০ নম্বরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ও ১৫১ থেকে ২০০ হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১ থেকে ৩০০ হলে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুর শহর হিসেবে ধরা হয়। নম্বর ৩০১-এর বেশি হলে বায়ুর মানকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ধরা হয়।
ক্যাপস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আট বছরে ঢাকার বায়ুমান নম্বর চার বছর (২০১৬, ২০১৭, ২০১৯ ও ২০২০) সংবেদনশীল গোষ্ঠীর (শিশু, প্রবীণ) জন্য অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে ছিল। সর্বশেষ তিন বছরসহ বাকি পাঁচ বছর ছিল অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভীতিকর দিকটি হলো ২০২০ সালের পর থেকে ঢাকার গড় বায়ুমান নম্বর বাড়ছে। মানে হলো দূষণ বাড়ছে। কিন্তু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। দূষণের উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে একধরনের নির্লিপ্ততা চোখে পড়ছে।’
ঢাকায় বায়ুর মান বেশি খারাপ থাকে শীতে। বর্ষায় মোটামুটি গ্রহণযোগ্য থাকে। ক্যাপসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আট বছরে ২০২২ সাল ছাড়া প্রতিবছরই জানুয়ারি মাসে বায়ুর মান বেশি খারাপ ছিল। কম খারাপ ছিল জুলাই ও আগস্টে। এই দুই মাসে বৃষ্টি হয়।
ফলে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি হলে ঢাকার মানুষ মোটামুটি নির্মল বায়ুতে শ্বাস নিতে পারে। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পর অক্টোবর মাস থেকে দূষণ বাড়তে থাকে।
ঢাকায় ২০২৩ সালে গড় বায়ুর মান আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ থাকলেও সব মাসে পরিস্থিতি এমন ছিল না। ক্যাপসের বিশ্লেষণ বলছে, মার্চ, জুন, জুলাই, সেপ্টেম্বর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে আগের বছরের সংশ্লিষ্ট মাসের তুলনায় বায়ুদূষণ কম ছিল।
ঢাকার বায়ুদূষণ পরিস্থিতি কেমন, তা বুঝতে সাদা রঙের কাপড় দিয়ে বানানো একটি কৃত্রিম ‘ফুসফুস’ রাস্তার পাশে দুই দফা রেখে দিয়েছিল শক্তি ফাউন্ডেশন নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। প্রথমবার গত অক্টোবরে, দ্বিতীয়বার ডিসেম্বরে। মিরপুরে সংস্থাটির কার্যালয়ের সামনে রাখা ওই সাদা কাপড়ের ফুসফুস প্রথম দফায় ২১ দিনে, দ্বিতীয় দফায় ১৪ দিনে ধূসর হয়ে যায়।
শক্তি ফাউন্ডেশন জানায়, ধুলাবালুর কারণে কাপড়টির রং কত দ্রুত বদলায়, তা দেখে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বোঝা যায়। শুধু ঢাকায় নয়, ভারতের নয়াদিল্লি, বেঙ্গালুরু, লক্ষ্ণৌ, মুম্বাই ও লুধিয়ানা এবং নেপালের কাঠমান্ডুতে এর আগে এভাবে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা হয়েছে।
শক্তি ফাউন্ডেশনের জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক সাব্বির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিদিন কাপড়ের রং কতটুকু বদলেছে, তা আমরা পরিমাপ করেছি। আমরা দেখেছি, কাঠমান্ডু ছাড়া বাকি শহরগুলোর তুলনায় ঢাকায় রং সবচেয়ে কম সময়ে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে।’
ঢাকার বায়ুদূষণ যে বাড়ছে, তা স্বীকার করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মোহাম্মাদ আব্দুল মোতালিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূষণ যে বাড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দূষণের উৎসগুলোর মধ্যে আছে উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুপ্রবাহ, রান্নার ধোঁয়া, কলকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের দূষণ। উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা হচ্ছে।’
বায়ুদূষণের প্রসঙ্গ এলে দূষণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা উপমহাদেশীয় দূষিত বায়ুপ্রবাহের বিষয়টি সামনে রাখেন। গত বছর মার্চে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গবেষণা ‘নির্মল বায়ুর জন্য চেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ ও জনস্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশের ওপর দিয়ে একই মেঘমালা উড়ে যায়। ওই মেঘের মধ্যে দূষিত বায়ু গিয়ে আশ্রয় নেয়, যা বাংলাদেশেও দূষিত বায়ু ছড়িয়ে দেয়।
অবশ্য গবেষকদের মত, ঢাকার বায়ুদূষণে এই বায়ুপ্রবাহের দায় গড়ে ৩০ শতাংশের বেশি নয়। বাকিটার জন্য দায়ী স্থানীয় উৎস। সেই উৎসগুলো বন্ধে নামকাওয়াস্তে কিছু অভিযান চলে। সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ কম।
যেমন ঢাকায় বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাসের কালো ধোঁয়া। রাজধানীতে প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মেট্রোরেল অবকাঠামোর ওপর দিয়ে বিদ্যুৎ-চালিত ট্রেন চলছে। তার নিচেই কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে চলছে পুরোনো বাস। ফলে দূষণ কমছে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বায়ুদূষণ রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও জরিমানার তথ্যগুলো থাকে। ওয়েবসাইট ঘেঁটে ঢাকায় গত মাস ডিসেম্বরে (১৮ ডিসেম্বর) যানবাহনের কালো ধোঁয়া দ্বারা বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে শুধু একটি অভিযানের তথ্য পাওয়া যায়। ওই অভিযানে পুরান ঢাকার টিকাটুলীতে ৫টি যানবাহনকে ৮ হাজার ৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণ রোধে সরকার ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে অন্তত সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যা বর্তমানে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার সমান। নতুন করে বায়ু, পানিদূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশে টেকসই পরিবেশ ও রূপান্তর’ শিরোনামে আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে। এতে ২৫ কোটি ডলার (২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা) অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক।
বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্প নিলে অর্থ ব্যয় হবে। কিন্তু পুরোনো বাস উঠিয়ে নেওয়া, যানবাহনে কম দূষণকারী জ্বালানির ব্যবহার, দূষণকারী ইটভাটা বন্ধ করা, নির্মাণসামগ্রীর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও শহরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর না দিলে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সালাম দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার বায়ুদূষণের স্থানীয় উৎস, যেমন যানবাহন ও কলকারখানার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। অনেক প্রকল্প হয়েছে, কিন্তু এর সুফল দেখা যাচ্ছে না।’
বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। রাজধানীতে বায়ুদূষণের কারণে কত মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে, তার হিসাব নেই।
তবে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে যাওয়া বক্ষব্যাধির রোগীর সংখ্যা জানা যায়। হাসপাতালটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে এ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে রোগীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৫৯। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত ১১ মাসে রোগী দাঁড়ায় ১১ হাজার ৩৭৩ জনে।
বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ আবদুস শাকুর খান প্রথম আলোকে, করোনার পর থেকে শ্বাসতন্ত্রের নানা অসুখের রোগী বেড়েছে। বায়ুদূষণের সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে। তিনি বলেন, ‘এখন শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগের বিস্তার যতটা দেখছি, আগে তা চোখে পড়েনি।’