কড় রাজহাঁস, রাজশাহীর পদ্মার চরে
কড় রাজহাঁস, রাজশাহীর পদ্মার চরে

এ দেশের যত রাজহাঁস

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের গুয়েলপ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ১৯৯৮ সালে সুদর্শন ডোরা-মাথার পাখিগুলোকে দেখি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাঁস-রাজহাঁসের উদ্যান ‘কোর্টরাইট ওয়াটারফাউল পার্ক’-এ। এরপর ১৮ বছর গত হয়েছে। রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে ২০১৬ সালে বিরল ও দুর্লভ পাখির সন্ধানে গিয়ে আবার ওদের সঙ্গে দেখা। আগের দিন বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী ক্যাপ্টেন কাওসার মোস্তফা, রাজশাহীর পক্ষী আলোকচিত্রী মারুফ রানা ও শোভন আহমাদুজ্জামানকে নিয়ে নুর ইসলাম নুরুর নৌকায় সারাটা দিন খুঁজেও ওদের দেখা পাইনি। পরদিন আমি ও কাওসার পদ্মার অন্য একটি চরে গেলাম। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর নুরুর ফোন পেয়ে দ্রুত বটতলা ঘাটে চলে এলাম। আমরা এলে নুরু নৌকা ছাড়ল।

 নৌকা দ্রুত স্পটের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে আমার বেশ টেনশন হচ্ছে। কে জানে ওখানে পৌঁছানো পর্যন্ত পাখিগুলো থাকবে কি না? যাহোক, দ্রুতই চর খানপুর ও চর মাজারদিয়ারের মাঝামাঝি চলে এলাম। দূর থেকে পাখিগুলোকে দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। একটি নয়, দুটি নয়, চার–চারটি পাখি। নুরুকে নৌকা থামাতে বললাম। এরপর হাঁটুসমান পানিতে ক্যামেরা হাতে নেমে পড়লাম। ধীরে ধীরে পানি কেটে পাখিগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে শাটারে ক্লিক করে গেলাম।

এরপর নবগঙ্গার দিকে নৌকা ঘোরালাম। প্রচণ্ড রোদে যেন পুড়ে যাচ্ছি। নবগঙ্গায় কিছুই পেলাম না। ওখান থেকে ফেরার পথে ঘাটের কাছে এসে আরও সাতটি পাখির দেখা পেলাম। মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দুটি স্পটে মোট ১১টি পাখির দেখা পেয়েছি। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে আগ্রায় তাজমহলের পেছনে যমুনা নদীতে শ খানেক একই প্রজাতির পাখিকে ভেসে বেড়াতে দেখলাম।

সুদর্শন এই পাখিগুলো একধরনের রাজহাঁস। হাঁস, রাজহাঁস (Geese) ও মরাল বা লম্বা গলার রাজহাঁস (Swans) অ্যানসেরিফরমেস বা সন্তরক বর্গ ও অ্যানাটিডি অর্থাৎ হংস গোত্রের সদস্য। পৃথিবীর কমবেশি ২০ প্রজাতির রাজহাঁসের মধ্যে এ দেশে শীতে চারটির আগমন ঘটে। এদের মধ্যে দুটি প্রজাতি প্রতিবছর ও বাকি দুটি কালেভদ্রে আসে। এ দেশে আসা চার প্রজাতির রাজহাঁসেরই আয়ুষ্কাল ১১ থেকে ১২ বছর। এখানে ওদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।

১. কড় রাজহাঁস (বার-হেডেড গুজ): এতক্ষণ যে পাখির গল্প বললাম, ওরা কড় রাজহাঁস। এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখিটি কলহংস, রাজহংস, ডোরা–মাথা/ময়াল রাজহাঁস নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে বড়ি/বাদি হাঁস। বৈজ্ঞানিক নাম Anas indicus। এরা অত্যন্ত উঁচু দিয়ে ওড়ে। হিমালয়ের ৯ হাজার ৩৭৫ মিটার উঁচু দিয়ে ওড়ার রেকর্ড আছে। জনবসতিহীন দ্বীপ, বড় নদীর চর ও জলজ উদ্ভিদপূর্ণ জলাশয়ে বিচরণ করে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য ৭১ থেকে ৭৬ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৮ থেকে ৩.২ কেজি।

২. ধূসর রাজহাঁস (গ্রেল্যাগ গুজ): এটিও এ দেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। ছাইরঙা রাজহাঁস নামেও পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে বলে কাদম্ব বা রাজহাঁস। বৈজ্ঞানিক নাম Anser anser। মূলত শীতপ্রধান এলাকা, যেমন আইসল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ, পোল্যান্ড, সাইবেরিয়া, মধ্য এশিয়া প্রভৃতির বাসিন্দা। শীতে চট্টগ্রাম ও খুলনা বিভাগের উপকূল এবং সিলেট, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগের হাওর-বিল, বড় জলাশয়, নদী ও চরে দেখা মেলে। শ্রীমঙ্গলের হাইল হাওরে ১৯৯৬ সালে প্রথম দেখি। দৈর্ঘ্য ৭৫ থেকে ৯১ সেন্টিমিটার। ওজন ৩ থেকে ৩.৩ কেজি।

উড়ন্ত ধূসর রাজহাঁস, শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে

৩. বড় সাদা-কপাল রাজহাঁস (গ্রেটার হোয়াইট-ফ্রন্টেড গুজ): তথ্য অপ্রতুল প্রজাতিটি এ দেশে অনিয়মিতভাবে আসে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরইল বিলে দেখা গেছে। কানাডার কোর্টরাইট ওয়াটার ফাউল পার্কে দেখেছি। বৈজ্ঞানিক নাম Anser albifrons। মূলত উত্তর ও মধ্য আমেরিকা, ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার বাসিন্দা। দেহের দৈর্ঘ্য ৬৪ থেকে ৮১ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৯ থেকে ৩.৩ কেজি।

৪. ছোট সাদা-কপাল রাজহাঁস (লেসার হোয়াইট-ফ্রন্টেড গুজ): বড়টির মতো ছোট সাদা-কপাল রাজহাঁসেরও কোনো প্রচলিত বাংলা নাম নেই। পশ্চিমবঙ্গে বলে বেঁটে রাজহাঁস। বৈজ্ঞানিক নাম Anser erythropus। এটিকেও কানাডায় দেখেছি। মূল আবাস সাইবেরিয়া। শীতে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ ও পূর্ব-মধ্য চীনে পরিযায়ন করে; ক্বচিৎ ইংল্যান্ড ও ভারতে আসে। সূত্রমতে, ২০১১ সালে মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরে একবার দেখা গিয়েছিল। বিশ্বব্যাপী এটি সংকটাপন্ন। দৈর্ঘ্য ৫৩ থেকে ৬৬ সেন্টিমিটার। ওজন ১.৪০ থেকে ২.৫ কেজি।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি বন্য প্রাণী প্রজনন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ