খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে ফোটা রুদ্রপলাশ ফুল
খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে ফোটা রুদ্রপলাশ ফুল

বিরল হলুদ রুদ্রপলাশ

পশ্চিমে সূর্য খানিকটা হেলে পড়েছে। কম তেজি সেই বাসন্তী রোদের সোনালি ঝিলিক ঠিকই ঠিকরে পড়েছে একটি গাছের সবুজ ঘন পত্রপল্লবের শিখরে শিখরে ফুটে থাকা শত শত রৌদ্রবতী ফুলের ওপর। রোদে আর ফুলের রঙের মাখামাখি—এ এক অপূর্ব আলো আর রঙের মিলন। ফুলগুলো যেন বিকেলে ক্ষয়ে যাওয়া রোদের আগুনে শিখার মতো জ্বলছে। সে জন্যই কি এই ফুলের নাম রুদ্রপলাশ?

খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে ফেব্রুয়ারির বিকেলটা রুদ্রপলাশের রুদ্ররূপে যেন অন্য রকম হয়ে উঠল। পূর্ব দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একমাত্র সে গাছটিতে ফুটে আছে অনেকগুলো রুদ্রপলাশের ফুল।

কিন্তু যে কারণে নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা আফ্রিকান টিউলিপের বাংলা নাম বলেছিলেন রুদ্রপলাশ, সেটা তো এই রুদ্রপলাশ না। সে রুদ্রপলাশ ফুলের রং ছিল আমাদের পলাশ ফুলের মতো টকটকে লাল ও কমলার মিশেলে, আর এ ফুলটার রং কাঁচা সোনার মতো হলুদ। জীবনে কখনো দেখা হয়নি হলুদ রুদ্রপলাশের সঙ্গে। তাই এ ফুলগুলোকে দেখে ছবি তোলার জন্য যেমন অস্থির হলাম, তেমনি ওর কথা জানার জন্যও উদ্‌গ্রীব হলাম।

রুদ্রপলাশের ফুল প্রথম দেখেছিলাম ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে। বেরাটান হ্রদে যাওয়ার পথে তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা পথের পাশে সারি করে লাগানো বহু রুদ্রপলাশগাছের সারি। লম্বা ও ঝাঁকড়া পাতার গাছের মাথাজুড়ে দেখেছিলাম লাল-কমলা রুদ্রপলাশ ফুলের দাপাদাপি। চিরবসন্তের সেই দেশে অবশ্য জানা হয়নি রুদ্রপলাশ সে দেশে সারা বছরই ফোটে কি না। তবে দেশে এসেই জেনেছিলাম, আমাদের দেশেও রুদ্রপলাশের গাছ আছে।

রাজশাহী থেকে প্রথম আলোর সাংবাদিক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ জানিয়েছিলেন, রাজশাহী নগরের ডিঙ্গাডোবা মিশন হাসপাতাল চত্বরে রয়েছে রুদ্রপলাশগাছ, ফুলও ফোটে। অবশ্য এর আগে রমনা উদ্যানে দেখেছিলাম রুদ্রপলাশের গাছ। কিন্তু সে গাছে তখন ফুল দেখার সুযোগ হয়নি। যখন ফোটে, তখন যাওয়া হয় না। অনেক পরে যখন রমনা লেকের ধারের গাছটিতে ফুল দেখেছিলাম, তার রংও দেখলাম লাল। দুর্লভ এই হলুদ রুদ্রপলাশের এই প্রথম দেখা পেলাম খুলনায়। হয়তো কেউ সেই পার্কে গাছটি লাগিয়েছিলেন রুদ্রপলাশগাছ হিসেবেই, কিন্তু তিনিও হয়তো তখন ভাবেননি যে সে গাছে ফুটবে হলুদ ফুল। এ যেন কবি সোমাদ্রির ‘রুদ্রপলাশ’ কবিতার শেষ দুটি লাইনের সেই আশা: ‘মানুষের মনে সোনার বাংলার আশ/ সুস্থ হওয়ার সত্য, দিলাম রুদ্রপলাশ।’

ঢাকায় ফিরে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের সাবেক বোটানিস্ট সামসুল হককে জানালে তিনিও বললেন, দেশে আর কোথাও হলুদ রুদ্রপলাশ আছে বলে মনে হয় না, তাঁর চোখেও কখনো এ গাছ চোখে পড়েনি। এ দেশে হলুদ পলাশ আছে, হলুদ শিমুল আছে কিন্তু হলুদ রুদ্রপলাশ সত্যিই বিরল। জায়েদ ফরিদের একটি লেখায় পেলাম, অস্ট্রেলিয়াতে হলুদ বা স্বর্ণাভ ফুলের একটি জাত বা কাল্টিভার উদ্ভাবিত হয়েছে, যার উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Spathodea companulata ‘Aurea’, গোত্র বিগ্নোনিয়েসি। আফ্রিকার গোল্ডকোস্টে রুদ্রপলাশের গাছ প্রথম দেখা যায়। লাল রুদ্রপলাশ (Spathodea companulata) ও হলুদ রুদ্রপলাশ একই গোত্রের গাছ, শুধু জাত আলাদা, বহুবর্ষী বৃক্ষ। এ গাছের কাণ্ডের কাঠ খুব নরম ও ভেতরটা ফাঁপা ধরনের। যে কারণে এর ডালে কাঠঠোকরা পাখিরা গর্ত করে বাসা বানায়। তবে সেসব পাখিরও কি বুদ্ধি! ঠুকরে গর্ত বানানোর সময় যেসব কাঠের টুকরা বের হয়, সেগুলো তারা গাছের তলায় ফেলে না রেখে মুখে করে দূরে ফেলে দিয়ে আসে, যেন ওদের শিকারি কোনো প্রাণী ঘুণাক্ষরেও ওদের বাসার হদিস না পায়।

রুদ্রপলাশের মতোই হলুদ রুদ্রপলাশের পাতা ও ফুলের চেহারা, শুধু ফুলের রং আলাদা। একটি পাতায় ৭ থেকে ১০টি ছোট ছোট পত্রক থাকে, পত্রদণ্ডের দুই পাশে সেগুলো সাজানো থাকে আর মাথায় থাকে একটি পত্রক। ফুলের বৃতিগুলো দেখতে অনেকটা বাঘের নখের মতো। না ফোটা এসব কুঁড়ি ও কাপের মতো ফোটা ফুলের ভেতরে জমে থাকে জল।

কুঁড়ির মাথা ফুটো করলেই সে জল বেরিয়ে আসে। ফুলে জমে থাকা জল পাখিদের পানের জন্য যেন ফোয়ার জল। আর বীজগুলো অদ্ভুত! দেখলে মনে হয় কেউ যেন হৃৎপিণ্ডাকার বীজটা স্বচ্ছ পলিথিনের প্যাকেটে ভরে রেখেছে। হালকা বলে বীজগুলো নৌকার মতো ফল ফাটার পর বাতাসে ভেসে ভেসে দূরে চলে যায়।

  • মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক