বঙ্গোপসাগরে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪ ডিগ্রি বেশি তাপমাত্রা। তৈরি হচ্ছে প্রচুর জলীয়বাষ্প। তিন দিনে ফেনীতে ১৮১ মিলিমিটার বৃষ্টি।
সাধারণত মার্চে দেশের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। মাসের শেষের দিকে শুরু হয় কালবৈশাখী। বাংলা চৈত্র মাস শুরুর এই সময়ে গরম বাড়তে থাকে। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে উল্টো ঘটনা ঘটছে। কালবৈশাখী ছাড়াই বৃষ্টি ঝরেছে।
গত কয়েক দিনে রীতিমতো বর্ষার আদলে বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঘনকালো মেঘ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। উপকূল থেকে উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, আগামী এক সপ্তাহে সিলেট ছাড়া সারা দেশে বৃষ্টি কমতে পারে। তাপমাত্রা বেড়ে গ্রীষ্মের আবহাওয়া ফিরতে পারে।
কিন্তু হঠাৎ চৈত্রের শুরুতে বর্ষাকালের মতো বৃষ্টি নামায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আবহাওয়াবিদেরা। কারণ, আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে সাধারণত মার্চে সারা দেশে গড়পড়তায় ৫২ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। চলতি মাসের জন্য দেওয়া পূর্বাভাসে সংস্থাটি স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা বলেছিল। কিন্তু এবার তা উল্টো হতে যাচ্ছে।
খোদ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে, গত চার দিনে শুধু ফেনী জেলাতেই ১৮১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর সারা দেশ মিলিয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৩০০ মিলিমিটার ছাড়িয়ে গেছে। এই সময়ে বৃষ্টির সঙ্গে যে দমকা হাওয়া থাকে, এবার তা–ও ছিল না। বরং বর্ষার মতো মেঘ কালো করে অঝোরধারায় বৃষ্টি ঝরেছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে হঠাৎ নামা এ ভারী বৃষ্টির কারণ অনুসন্ধানে গতকাল বুধবার সকালে একটি বিশেষ সভাও হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত এই সময়ে কালবৈশাখীসহ হালকা বৃষ্টি ও বজ্রপাত হয়। কিন্তু দু–তিন দিন ধরে সারা দেশে বর্ষাকালের মতো ভারী বৃষ্টি হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি পুবালি বাতাসের প্রভাবে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে বৈশ্বিক আবহাওয়ার অন্যতম প্রভাবক ‘মেডেন জুলিয়ান অসিলেশন’ বা এমজেও চক্র কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ বিশ্ব আবহাওয়া দিবস পালিত হবে। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘ভবিষ্যতের আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং সব প্রজন্মের জন্য পানির সরবরাহ।’ বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণ ক্ষয়ক্ষতি এবং প্রস্তুতি সম্পর্কে সচেতন করতে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা এ দিবস পালন করে থাকে।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, তিন বছর ধরে বাংলাদেশে কম বৃষ্টি হয়েছে। এর কারণ মূলত দুটি। প্রথমত প্রশান্ত মহাসাগর এলাকা থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকাজুড়ে লা নিনা সক্রিয় ছিল। এটি সক্রিয় থাকলে সাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়। ফলে আমেরিকা মহাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া হয়ে দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে বৃষ্টি কম হয়।
অপরদিকে ভারত মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে একই ধরনের আরেকটি পরিস্থিতি তৈরি হয়, যাকে ইন্ডিয়ান ওশান ডাইপল বা ভারত মহাসাগর দ্বিচক্র–আইওডি বলা হয়ে থাকে। এটিও দুই বছর ধরে কম সক্রিয় ছিল। এতেও বৃষ্টি কম হয়ে থাকে, হয়েছেও তাই। ফলে তিন বছর ধরে দেশে বৃষ্টি কম হওয়ার জন্য ওই পরিস্থিতি দায়ী।
তিন বছর ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে লা নিনা এবং ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর এলাকায় আইওডি পরিস্থিতি অব্যাহত থাকাকে আবহাওয়াবিদেরা ব্যতিক্রম হিসেবে মনে করছেন। সাধারণত আবহাওয়ার ওই দুই বিশেষ অবস্থা টানা এক থেকে দুই বছরের বেশি সক্রিয় থাকে না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বৈশ্বিক আবহাওয়ার আরেকটি প্রভাব সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আবহাওয়াবিদেরা একে বলেন ‘মেডেন জুলিয়ান অসিলেশন–এমজেও চক্র’। মেডেন ও জুলিয়েন নামে দুই আবহাওয়াবিদ ১৯৭০ সালে আবহাওয়ার এ বিশেষ অবস্থাকে চিহ্নিত করেন।
ওই এমজেও বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন মহাসাগরে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এটি যে এলাকায় সক্রিয়, সেখানে বৃষ্টি বেড়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে তা আরব সাগর দিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে চলতি মাসের মাঝামাঝি বঙ্গোপসাগরে চলে আসে। এতে এক সপ্তাহ ধরে ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত হয়ে যায়।
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, লা নিনা ও আইওডি ইতিবাচকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাত বেড়ে যায়। বঙ্গোপসাগরেও একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। এ যে কারণে এবার এপ্রিল–মে থেকে বৃষ্টি বাড়বে। এরপর জুন থেকে বর্ষা শুরু হলে বৃষ্টি আরও বাড়বে, যা বন্যার ঝুঁকি বাড়াবে।
যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং এল নিনো ও লা-নিনা গবেষক রাশেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক যুগ ধরে আমরা দেখছি বাংলাদেশের আবহাওয়াকে এল নিনো ও লা নিনা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। কারণ, আবহাওয়ার এখানকার বৃষ্টিপাত বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে আমাদের বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে হবে। কারণ, এখানকার কৃষি ও ফসলের উৎপাদন ওই বৃষ্টিপাতের ওপরে অনেকটা নির্ভরশীল। তাই আমাদের আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচিত এক বা দুই দিনের আবহাওয়া পূর্বাভাসের পাশাপাশি এল নিনো, লা নিনা, আইওডিসহ অন্যান্য যেসব বৈশ্বিক প্রভাবগুলো বিশ্লেষণ করে তথ্য দেওয়া।’