ছানাসহ খয়রা কাস্তেচরা নামের একটি বিরল পাখির দেখা মিলেছে। পাখিদেখিয়েদের কাছে এটি বড় খবর। আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে! গত বছর বন অধিদপ্তরের পাখিবিদ শিবলী সাদিকের কাছ থেকে এই পাখির খবর পেয়েছিলাম। পাখির কলোনি নিয়ে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে তিনি গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহ করছেন। গত কয়েক বছর ওই অঞ্চলের পাখি কলোনিগুলোতে পাখিটির উপস্থিতি ছিল। এ বছর দেখা পাওয়া গেল বাসা ও ছানার। আমার কাছে সত্যিই দারুণ খবর! কারণ, এক যুগের বেশি সময় ধরে এই পাখির শীতকালীন পরিযায়ন ও শুমারিতথ্য নিয়ে আমি পর্যালোচনা করছি।
খয়রা কাস্তেচরা এ দেশের পরিযায়ী পাখি। শুধু শীত মৌসুমে এই পাখির দেখা পাওয়া যায়। পাখিটি প্রথমবার ছবিসহ শনাক্ত হয়েছিল ২০১১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে পাখিদেখিয়ে বন্ধু তৌহিদুর রহমান পাখিটির ছবি তুলেছিলেন। সংখ্যায় ছিল মাত্র তিনটি। তার ছবি তোলার পর আমরা সবাই পাখিটির খোঁজে হাওরে গিয়েছিলাম। পাখিটি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল সে সময় অনেকেরই। তার পর থেকে প্রতিবছরই খয়রা কাস্তেচরার দেখা মেলে হাওরে। ২০১৪ সালে ১০টি পাখির একটি দল দেখা যায়। ২০১৬ সালে এসে পাখির এই দল আরও বড় হতে থাকে। সে বছর দেখা পাওয়া যায় ৭৭টি পাখি এবং তার পরের বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫০টিতে।
খয়রা কাস্তেচরার দল এখন নিয়মিত দেশের বিভিন্ন জলাশয়েও দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বাইক্কা বিল, হাকালুকি হাওর, পদ্মার বিভিন্ন এলাকা এমনকি উপকূলীয় এলাকায়ও এদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে। চার বছর ধরে এদের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি হয়েছে। গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গুয়ার চটাইন্ন্যা বিলে ২ হাজার ৮৬০টি খরয়া কাস্তেচরা গণনা করেছি। আর এ বছরের জানুয়ারিতে টাঙ্গুয়ায় দেখা গেছে প্রায় ৩ হাজার ৩০০ পাখির একটি বড় দল। সারা দেশে এখন প্রতি শীতে হাজার সাতেক খয়রা কাস্তেচরা দেখার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
শীতে পরিযায়ী হয়ে আসা পাখির দলের এ দেশে বাসা করে ছানা ফোটানোর ঘটনা একেবারেই বিরল। খয়রা কাস্তেচরার ক্ষেত্রে তা একেবারেই ব্যতিক্রম। এ দেশে পরিযায়ী হয়ে আসা পাখিটি এখন আবাসিক পাখির মর্যাদা পাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে পাখিটির একটি অংশ এ দেশে থেকে যাচ্ছে। এ বছর প্রজনন মৌসুমে উত্তরবঙ্গের ৫-৬টি পাখি কলোনিতে প্রায় ৩৬২টি প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেখা পাওয়া গেছে। এ দেশে পরিযায়ী হয়ে আসা মোট খয়রা কাস্তেচরার প্রায় পাঁচ ভাগ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার কাজীপাড়া গ্রামে। সংখ্যায় প্রায় ২০০। এই জেলার সদর উপজেলার একটি কলোনিতে ৫৮টি পাখির দেখা পাওয়া গেছে। আনন্দের খবর হলো, এ কলোনিতে সাতটি বাসারও সন্ধান পাওয়া গেছে। আর এখানে দেখা পাওয়া গেছে দুটি ছানার। এ বছরই প্রথম দেখা গেল ছানাসহ পাখির সংসার।
খয়রা কাস্তেচরার আরেকটি দল জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার পুন্ডরিয়া পাখি কলোনিতেও দেখা গেছে। এখানে বাসা না পাওয়া গেলেও প্রায় অর্ধশত পাখির উপস্থিতি আছে। এ ছাড়া এর পাশের জেলা নওগাঁর নিয়ামতপুরের হাজীনগর গ্রামে একটি কলোনিতে দেখা পাওয়া গেছে প্রায় ৬০টি খয়রা কাস্তেচরার। আর মহাদেবপুরের আলীদেওনা গ্রামের পাখি কলোনিতে দেখা গেছে ২০-২৫টি। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার রামনগরের একটি কলোনিতেও এই জাতের ৬০-৭০টি পাখি দেখা গেছে।
খয়রা কাস্তেচরার মতো একটি বিরল পাখি সংখ্যায় বেড়ে এ দেশে নিয়মিত হচ্ছে। যেসব কলোনিতে এই পাখি দেখা যাচ্ছে, সেখানে একটি নিরাপদ আবাস গড়ে তুলতে পারলে আগামী মৌসুমে আরও বাসা ও ছানা পাওয়া যাবে। আর তা নিশ্চিত হলে আমাদের দেশ এই পাখি সংরক্ষণে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
সীমান্ত দীপু, বন্য প্রাণী গবেষক