মিথেন গ্যাস রাজধানী ঢাকার বাতাসকে বিপজ্জনক করে তুলছে
মিথেন গ্যাস রাজধানী ঢাকার বাতাসকে বিপজ্জনক করে তুলছে

গবেষণার তথ্য

বিপজ্জনক মিথেন গ্যাসে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটার ১৪ মার্চ একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। বিশ্বের ৬১টি শহরের ওপর করা ওই গবেষণা অনুযায়ী মিথেন গ্যাস নির্গত হওয়া শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়

সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার কয়েকটি ভবনে আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া মিথেন গ্যাসের কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আর গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুমণ্ডলেও বিপজ্জনক ওই গ্যাসের একটি স্তর তৈরি হয়েছে। বিশ্বের ৬১টি শহরের ওপর করা ওই গবেষণা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি মিথেন গ্যাস নির্গত হয়-এমন শহরের শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তানের করাচি; এরপরই ঢাকার অবস্থান।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ লেটারস-এ ১৪ মার্চ গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

মিথেন তাপমাত্রা বাড়ায়, অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এতে শহরের অধিবাসীদের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা বাড়ছে

প্রাকৃতিক গ্যাসের অন্যতম উপাদান হলো মিথেন গ্যাস। ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভূ-উপগ্রহ থেকে নেওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে মোট ৮৮৭ দিন ঢাকার বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতির ছবি নেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ঢাকার বায়ুমণ্ডলে ওই সময়ের মধ্যে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে ২১ দশমিক ১ পিপিবি (পার্টস পার বিলিয়ন)। আর পাকিস্তানের করাচি শহরে ঢাকার চেয়ে সামান্য বেশি, ২২ দশমিক ৫ পিপিবি।

ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে শহর এলাকায় উচ্চমাত্রায় মিথেন গ্যাস নিঃসরণের কারণ অনুসন্ধান এবং এর সঙ্গে অপরিশোধিত বর্জ্যপানির সম্পর্ক নিয়ে এই গবেষণায় বিশ্বের উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত-তিন ধরনের দেশের শহরকে বেছে নেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়, সেইন্ট লুইস বিশ্ববিদ্যালয়, উইসকনসিন স্টেট ল্যাবরেটরি অব হাইজিন ও নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন।

ঢাকার কঠিন ও তরল বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস বের হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে আমার কাছে মনে হয়, এর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে রাজধানীর ভবন ও শিল্পকারখানার গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র
অধ্যাপক আবদুস সালাম, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

গবেষক দলের প্রধান উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক জেমস জে শাওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন বিশ্বে মিথেন গ্যাসের প্রধান উৎস হিসেবে কৃষিকাজ ও গ্রামীণ জলাভূমিগুলোকে মূলত দায়ী করা হতো। আমাদের এই গবেষণায় বিশ্বের ৬১টি শহরে বিভিন্ন মাত্রায় মিথেন গ্যাস সৃষ্টির পেছনে গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র, বর্জ্য ও বর্জ্যমিশ্রিত পানির ভূমিকাকে চিহ্নিত করেছি। মিথেন গ্যাসের এসব উৎস শহরের বাতাসকে বিপজ্জনক করে তুলছে। একই সঙ্গে তা বিশ্বের তাপমাত্রাও বাড়াচ্ছে।’

ভাগাড়ের বর্জ্য থেকে ৪৭% মিথেন

ঢাকায় মিথেন গ্যাস সৃষ্টির কারণ হিসেবে শহরের ১৩টি স্থানের বর্জ্যের ভাগাড়ের কথা বলা হয়েছে। ওই সব ভাগাড়ে জৈব ও পলিথিন-প্লাস্টিক বর্জ্য উন্মুক্ত অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। এসব বর্জ্য পচে মিথেন গ্যাস তৈরি হচ্ছে। ঢাকার মোট মিথেনের ৪৭ শতাংশ সৃষ্টি হচ্ছে এই বর্জ্য থেকে। একই সঙ্গে শহরের বেশির ভাগ জলাভূমিতে জমা হওয়া দূষিত পানি এবং নদীগুলো দূষিত হয়ে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি করছে।

বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য আমিনবাজারে ঢাকা উত্তর সিটির ল্যান্ডফিল

ঢাকায় মিথেন গ্যাস বেশি হওয়ার পেছনে কিছু আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণের কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। শুষ্ক মৌসুমে এখানে উত্তর থেকে দক্ষিণে বাতাস প্রবাহিত হয়। ওই বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকে এবং বাতাস শুষ্ক থাকে। এ ধরনের আবহাওয়ায় মিথেন গ্যাস দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২১ লাখের বেশি ভবন ও স্থাপনা রয়েছে। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি এসব ভবনে ও স্থাপনায় গ্যাসের সংযোগ দিয়েছে। এর বাইরে রয়েছে অবৈধ সংযোগও। বৈধ-অবৈধ অনেক সংযোগই এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের ভাষ্য, সেখান থেকে প্রতিনিয়ত মিথেন গ্যাস বের হয়ে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে ২১ দশমিক ১ পিপিবি

গবেষণা দলের সদস্যরা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসে পরিবেশ অধিদপ্তরে প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেও প্রতিবেদনটি দেওয়া হয়েছে। মিথেন গ্যাস কমানোর ব্যাপারে সংস্থা দুটির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান) জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এই সময়ের মধ্যে এত দ্রুত কেন মিথেন গ্যাস বাড়ল, তা আরও ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।’

বাড়ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যা

গবেষণায় বলা হয়েছে, করাচি ও ঢাকার পরে রয়েছে নাইজেরিয়ার লাগোস, ইরানের তেহরান ও মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর। ঢাকায় মিথেন গ্যাস বেশি হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হিসেবে এর জনসংখ্যাকে দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, অন্য শহরগুলোর তুলনায় ঢাকার জনসংখ্যা অনেক বেশি। আর অধিবাসীদের বড় অংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের। ফলে শহরে বর্জ্যের পরিমাণও বেশি তৈরি হয়। বর্জ্যব্যবস্থাপনা যথেষ্ট দুর্বল। যে কারণে উন্মুক্ত স্থানে বর্জ্য বেশি সময় ধরে পড়ে থাকে।

বায়ুদূষণ ও বিপজ্জনক গ্যাস নিয়ে কাজ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন দুজন অধ্যাপকের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা ঢাকার বর্জ্যের পাশাপাশি বাসাবাড়ি-ভবন ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র থেকেও বিপুল পরিমাণে মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে বলে মনে করেন। ওই গ্যাস বদ্ধ ঘরে থাকার কারণে আগুন লাগা ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। আবার তা বায়ুমণ্ডলের অন্য মিথেন গ্যাসের সঙ্গেও যুক্ত হচ্ছে। ফলে সব মিলিয়ে ঢাকার বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে।

ঢাকায় এখনো দেখা যায় এমন বর্জ্যের ভাগাড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুদূষণ গবেষক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকার কঠিন ও তরল বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস বের হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে আমার কাছে মনে হয়, এর সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে রাজধানীর ভবন ও শিল্পকারখানার গ্যাস-সংযোগের ছিদ্র। এসব সংযোগ স্থাপনের পর আর মেরামত করা হয় না। ফলে ছিদ্র রয়ে যায় এবং তা থেকে গ্যাস নির্গত হয়। এসব গ্যাস ঘরের মধ্যে জমে বিস্ফোরণ ও আগুন সৃষ্টি করে। আর বাইরে বের হয়ে মিথেনের স্তরকে আরও ঘন করছে।’

আমরা প্রতিবেদনটি যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এই সময়ের মধ্যে এত দ্রুত কেন মিথেন গ্যাস বাড়ল, তা আরও ভালোমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে
জিয়াউল হক, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান)

এই গবেষকের মতে, মিথেন গ্যাস বেশি থাকলে তা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে। আবার তা স্থানীয়ভাবেও তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে গরমকালে মানুষের কষ্ট বাড়ে। আবার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। এতে শহরের অধিবাসীদের শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যা বাড়ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় ওই বর্জ্য ফেলে রাখা হয়েছে, সেই সব এলাকার অধিবাসীদের এ ধরনের সংকটে বেশি পড়তে হচ্ছে।