ঝাঁক বেঁধে উড়ছে সবুজ টিয়া পাখি। কিচিরমিচির শব্দে মুখর এলাকা। উন্মুক্ত নীল আকাশটা যেন একটা বিশাল ক্যানভাস। আর চিত্রকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ টিয়া পাখি। কখনো রংধনু, কখনোবা বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজের মতো নানা কসরতে ছবি এঁকে চলেছে। আবার সুযোগ বুঝে নেমে পড়েছে ধানখেতে, ঠিক বিমান অবতরণের মতো। ধানের শিষ নিয়ে মুহূর্তেই আবার বসছে গাছের ডালে।
এমন দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যের দেখা মিলছে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নিশ্চিন্তাপুর গ্রামের বিলে। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কের অ্যাভিয়ারি পার্কের পাশ ধরে এক কিলোমিটার গেলেই মিলবে এই টিয়ার দলের। প্রতিবছর হেমন্তকালে নবান্ন উৎসব তাদের যেন আমন্ত্রণ জানায় এখানে। এবার এসেছে ২০ থেকে ২৫ দিন আগে। টিয়ার এই ঝাঁক দেখে শিশু–কিশোরদের মধ্যে আনন্দের সীমা নেই।
হেমন্তের শেষ দিকে শীতের আমেজ পাওয়া যায়। গ্রামে তখন আমন ধান কাটার মৌসুম, নবান্ন উৎসব। ধানের গন্ধ পেলেই ঝাঁকে ঝাঁকে টিয়া পাখি ভিড় করে আশপাশের গাছপালায়। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় রয়েছে এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শস্যভান্ডারখ্যাত গুমাই বিল। প্রচলিত আছে, এই বিলের ধানে সারা দেশের আড়াই দিনের খাবার হয়। প্রতিবছর সেই বিলকে শিকারির চোখ করে টিয়ার দল। বিলের কোনো না কোনো অংশে নতুন ধান খাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তবে কৃষকেরাও টিয়ার কবল থেকে বাঁচতে তৎপর থাকেন।
গুমাই বিলের পরেই নিশ্চিন্তাপুর গ্রাম। পাশেই কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানখ্যাত বনাঞ্চল। পাহাড়ের নিচে নিশ্চিন্তাপুর বিল। সোনালি আমন ধানের ম–ম গন্ধ। এখন যদিও অনেকটা কেটে ফেলা হয়েছে; তারপরও নাড়ার ফাঁকফোকরে থাকা ধানের লোভে টিয়ার আনাগোনা থেমে নেই। কয়েকটি দলে বিভক্ত টিয়া পাখিগুলো একসঙ্গে ধানখেতে নামে।
আর টিয়ার এমন নাচন দেখতে ছুটছে কিশোরের দল। কিশোর জুবায়ের কাঁধে করে ছোট ভাইকে নিয়ে এসেছে বিলে টিয়া দেখার জন্য। সে বলে, প্রতিবছর এখানে টিয়া আসে। তা দেখতে দারুণ লাগে! কিচিরমিচির শব্দে মুখর পুরো গ্রাম। বিলের আশপাশের গাছপালায় ঠাঁই নিয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, মিষ্টি রোদে সকাল নয়টার দিকে গাছ থেকে টিয়া পাখির ঝাঁক বিলে নেমে আসছে। তবে রোদ কড়া হলে, বিশেষ করে ১০টার পর থেকে টিয়া আবার গাছে আশ্রয় নেয়। এরপর আবার পড়ন্ত বিকেলে টিয়া পাখিরা ধানখেতে দল বেঁধে নামে। প্রতিটি দলে কয়েক হাজার করে টিয়া থাকে। কখনো গোলাকৃতি, কখনোবা ঢেউয়ের মতো করে টিয়ারা উড়ে বেড়ায়। তারপর সুযোগ বুঝে নেমে পড়ে ধানের খেতে। বাতাসে নুয়ে পড়া ধানখেত টিয়াদের বেশি পছন্দ।
বিলের পাশে এক বৃদ্ধ কৃষকের সঙ্গে দেখা। তিনিও সহাস্যে অবলোকন করছিলেন টিয়ার আনাগোনা। তিনি বলেন, বিমানের মতো যখন নেমে আসে, তখন সুন্দর লাগে। একেকটি ঝাঁকে কয়েক হাজার টিয়া থাকে। যদিও আমাদের ধান খেয়ে ফেলে; এটা প্রত্যেক চাষির জন্য কষ্টের। তবে এখন ধান কাটার পর নাড়ার ফাঁকে পড়ে থাকা শিষ নিয়ে চলে যাচ্ছে টিয়া।
খাদ্যের অন্বেষণে টিয়া পাখি সব সময় বেছে নেয় নিরুপদ্রব অঞ্চল। সাধারণত ঘন গাছপালা, যেমন বড় বড় শিরীষ, নানা জাতের ফুল, আম, কড়ই ইত্যাদি গাছে তারা থাকতে পছন্দ করে। নিশ্চিন্তাপুর গ্রামটি সব দিক থেকে তাদের জন্য আদর্শ বলা যায়।
তবে নিশ্চিন্তাপুরে এসেও একেবারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে কোথায় টিয়ার দল। উপদ্রব থাকেই; থাকে জীবনশঙ্কাও। নিশ্চিন্তাপুরে ইতিমধ্যে দু–তিনটি টিয়া দুরন্ত কিশোরদের কাছে ধরা পড়েছে বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। সেগুলো মারাও গেছে ইতিমধ্যে।
খাবারের সন্ধানে আসা টিয়া পাখিগুলোর বেশির ভাগের ঠোঁট লাল। গলার নিচে কালো দাগ। বুকের অংশ গোলাপি। লেজসহ পিঠ ও পাখা পুরোটা সবুজে মোড়ানো। পাখনার ওপরে হালকা হলুদ রঙের আভা। মাথা ধূসর রঙের।