বাংলাদেশে মাত্র পাঁচ প্রজাতির বন্য প্রাণী সংরক্ষিত বনে ভালো পরিবেশে এবং পর্যাপ্ত সংখ্যায় টিকে আছে। মোট ১ হাজার ৯৭ প্রজাতির মধ্যে ২২ প্রজাতির বন্য প্রাণী খুঁজেই পাওয়া যায়নি। মানুষের নানা কর্মকাণ্ড এবং সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো গড়ে ওঠার কারণে এসব বন্য প্রাণী টিকে থাকতে পারছে না।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও বাংলাদেশের ১৪ জন গবেষকের করা এক সমীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গত ২০ অক্টোবর প্রকাশ করা এই আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সংরক্ষিত বন ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে। বন্য প্রাণীর সুরক্ষা দিতে ঘোষণা করা এসব এলাকায় মানুষের তৎপরতা ও সমাগম বেড়ে যাওয়ায় আগের মতো বন্য প্রাণীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।
শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ভালোভাবে বেঁচে আছে, এমন সৌভাগ্যবান পাঁচ প্রজাতি হলো—বাটাগুড় বাস্কা কাছিম, এশীয় উদ্বিড়াল বা ভোঁদড়, হলদে বাদামি হুতোমপ্যাঁচা, কালোমুখ প্যারাপাখি ও স্পটেট ব্ল্যাক ক্রো প্রজাপতি।
‘ইনসাইট ফ্রম সিটিজেন সায়েন্স রিভিল প্রায়োরিটি এরিয়া ফর কনজারভিং বায়োডাইভারসিটি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণাটিতে মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা বাংলাদেশের বিভিন্ন বনভূমিতে থাকা বন্য প্রাণীদের ছবি এবং তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বন্য প্রাণীদের শেষ আশ্রয়স্থল হলো সংরক্ষিত এলাকা। এসব এলাকার ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ত্রুটি আছে। সুন্দরবন ছাড়া এবং বাঘ-হাতির মতো বড় প্রাণী ছাড়া বাকি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে খুব বেশি কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় না। বন্য প্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হওয়ার প্রবণতা বন্ধ না হলে দেশ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী হারিয়ে যাবে।
গবেষণাটির নেতৃত্ব দেন অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. শাওন চৌধুরী। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার গবেষকদের পাশাপাশি এ গবেষণায় বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শরীফ আহমেদ মুকুল। এ গবেষণার জন্য সাতটি ফেসবুক গ্রুপে প্রকাশ করা মোট ৪৫ হাজার বন্য প্রাণীর ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বন ও বন্য প্রাণী নিয়ে এ ধরনের গবেষণা এটাই প্রথম।
সংরক্ষিত বন নষ্ট প্রক্রিয়ার সর্বশেষ উদাহরণ মৌলভীবাজারের পাথারিয়া বনাঞ্চলের লাঠিটিলা সংরক্ষিত বন। সেখানে সাফারি পার্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছেন পরিবেশবাদীরা। বনের ৫ হাজার ৬৩১ একর এলাকায় পার্ক নির্মাণের কারণে সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম হবে। এতে দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এই বনভূমির বন্য প্রাণী এবং জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাথারিয়া বনের প্রায় ২৫ হাজার একর বনভূমি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদ সিবিডির আওতায় করা কুনমিং-মন্ট্রিয়ল চুক্তিতে গত বছর সই করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে দেশের ১৭ শতাংশ ভূখণ্ড ও ১৩ শতাংশ সাগর এলাকাকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। বর্তমানে দেশের ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ স্থলভাগ এবং ৫ দশমিক ৪ শতাংশ সামুদ্রিক এলাকা সংরক্ষিত এলাকার আওতায় রয়েছে। বেশির ভাগ সংরক্ষিত এলাকার আয়তন খুব ছোট হওয়ায় তা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ চুক্তি অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের ৩০ ভাগ অঞ্চল সংরক্ষিত এলাকার আওতায় আনতে হবে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন, বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যমান সংরক্ষিত এলাকাগুলো যাতে এক ইঞ্চিও অন্য কাজে ব্যবহৃত না হয়, সে উদ্যোগ নিতে হবে। আর কুনমিং-মন্ট্রিয়ল চুক্তি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার পূরণ করতে হলে এ ধরনের এলাকা আরও বাড়াতে হবে। তা না করে উল্টো এসব এলাকায় সাফারি পার্কের মতো অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। এটা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের প্রকৃতি রক্ষায় দেশের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বনভূমিগুলোয় বিশ্বজুড়ে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বেঙ্গল টাইগার বা বাঘ-ভালুক, চামচ ঠুঁটো বাটান বা স্পুন বিলড স্যান্ডপাইপার এবং গাঙ্গেয় ডলফিন বাস করে। কমপক্ষে এক কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি বনের সম্পদ যেমন গাছ, মাছ, মধুসহ নানা সম্পদ সংগ্রহের ওপর নির্ভরশীল। বনের ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় গত ৮০ বছরে দেশের ৪০ শতাংশ এলাকার গাছপালা কেটে মানুষের বসতি তৈরি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১১ শতাংশেরও কম এলাকায় প্রাকৃতিক বন টিকে আছে।
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার দেশে সংরক্ষিত এলাকার পরিমাণ দ্রুত বাড়াচ্ছে। বন বিভাগ থেকে নিয়মিতভাবে সংরক্ষিত বন ব্যবস্থাপনায় কাজ করা হয়। একই সঙ্গে সুন্দরবনসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, আইইউসিএনের হিসাবে, বাংলাদেশে দশমিক ৮৭ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকাকে সঠিকভাবে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ১ হাজার ৯৭ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে ২৮৮টি বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। আর ৭৬৫ প্রজাতি বিপদে নেই। নিরাপদে থাকা পাঁচ প্রাণীর মধ্যে দুটি বিপদাপন্ন ও অন্য দুটি মহাবিপদাপন্ন প্রজাতির।
যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব সানশাইন কোস্ট, জার্মানির ফ্রেডরিক শিলার বিশ্ববিদ্যালয় ও হেলমটজ সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, জার্মান সেন্টার ফর ইন্টেগ্রেটিভ বায়োডাইভারসিটি রিসার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সেন্টার স্পুন বিলড স্যান্ডপাইপার করজারভেশন প্রকল্প বা চামচ ঠুঁটো বাটান পাখি সংরক্ষণ প্রকল্প, বাংলাদেশের ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল সেন্টার ফর স্পেসিস সারভাইভাল, কানাডার কার্লিটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা যৌথভাবে গবেষণাটি করেছেন।
বন বিভাগ থেকে বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ হেক্টর ভূমির মোট ৫২টি এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। সংরক্ষিত বনগুলো কতটুকু ভালো আছে, তা নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা ও সমীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিজ্ঞান সাময়িকী ‘জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট’-এ বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে একটি গবেষণা সমীক্ষা প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, শুধু ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৮৮ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের চুনতি বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম, মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান, চট্টগ্রামের হাজারিখিল বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম ও দুধপুকুরিয়া-ধোপাছড়ি বন্য প্রাণী অভয়াশ্রম এলাকা অন্যতম।
এর আগে ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বন বিভাগ দেশের ৩৭টি সংরক্ষিত এলাকার অবস্থা নিয়ে ‘বাংলাদেশের সংরক্ষিত এলাকার ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা করে। তাতে দেখা যায়, ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান সর্বোচ্চ ৩৬ শতাংশ হুমকিতে আছে। এরপর যথাক্রমে কক্সবাজারের হিমছড়ি ৩২ শতাংশ, মেধাকচ্ছপিয়া ৩০, বান্দরবানের ফাসিয়াখালী ২৮ শতাংশ হুমকিতে আছে। বাকি বনভূমি ও জাতীয় উদ্যানগুলোর হুমকি ২০ শতাংশের নিচে। সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশ এলাকা হুমকির মধ্যে পড়েছে মানুষের উপস্থিতির কারণে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের কারণে ২২ শতাংশ এবং কৃষি ও বাণিজ্যিক অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ৩৪ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষিত এলাকাগুলোর প্রায় ২৬ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত। বরিশাল বিভাগে এ ধরনের এলাকা রয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। প্রায় ৩৫ শতাংশ এলাকা খুলনা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে বিস্তৃত।
গবেষক দলের অন্যতম ড. শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের বনভূমি ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাগুলো যখন ধ্বংস হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, তখন সেগুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আর এসব ঘোষণা শুধু কাগজে-কলমে বেশি থেকেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি দেশের সামগ্রিক পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করতে চাই এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে চাই, তাহলে দেশের সব সংরক্ষিত এলাকাকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দিতে হবে।’