ইরশাদুলের চোখজুড়ানো বাগানবাড়ি

আবু ফারাক মো. ইরশাদুল বার, তাঁর স্ত্রী কাজী সোনিয়া ও মেয়ে সারাহ ইরশাদ
ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলা থেকেই ফুল-ফলের গাছ ও পশুপাখির প্রতি ছিল অনুরাগ। স্বপ্ন দেখতেন, বাড়ির চারপাশ সাজাবেন হরেক রকম ফুল ও ফলের গাছে। বাড়ির আঙিনায় ঘুরে বেড়াবে পশুপাখি। কিন্তু পড়ালেখা শেষে চাকরিতে যোগ দেওয়ায় তা আর হয়ে উঠছিল না।

২০০৫ সালে চট্টগ্রামের একটি শিপিং কোম্পানির চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। স্বপ্নপূরণের সুযোগ তৈরি হয় আবু ফারাক মো. ইরশাদুল বারের সামনে। দেড় একর জমির ওপর গড়ে তোলেন বাড়ি এবং বাড়িটিকে সাজান নিজের স্বপ্নের রং মেখে!

ইরশাদুলের বাড়িজুড়ে রয়েছে প্রায় ৪০ প্রজাতির ফুল, ফল ও ঔষধি গাছ। কৃষি উদ্যোক্তা ইরশাদুলের এ বাড়ির অবস্থান ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার বীরহলি গ্রামে।

বাড়ির আঙিনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজহাঁসের দল

ইরশাদুল জানান, আগে বাড়ির আঙিনায় পুষতেন শিয়াল, দেশি মুরগি, চায়না হাঁস। তবে দেখভালের লোকের অভাবে এখন এগুলো আর নেই। অবশ্য গরু, রাজহাঁস, কুকুর ও বিড়াল এখনো আছে।

ইরশাদুলের বাবা ইকরামুল হক ছিলেন সাবেক গণপরিষদ সদস্য (এমসিএ)। বাবাকে দেখতেন গ্রামের মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে। ইরশাদুলও বাবার মতো গ্রামে থাকার তাগিদ বোধ করতেন।

১২ সেপ্টেম্বর ইরশাদুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, এতে ঢোকার ফটকটি বাঁশের তৈরি। বাড়ির চারপাশেও বাঁশের বেড়া। এক পাশে গরুর গোয়াল, আরেক পাশে রাজহাঁসের খামার। বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে চন্দনা নদী। তবে স্থানীয় মানুষের মুখে এটি ‘চন্না নদী’।

ইরশাদুল যখন বাড়িটি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন, নাকে এসে ঝাপটা দিচ্ছিল নানা ফুলের ঘ্রাণ। কানে ভেসে আসছিল বিভিন্ন পাখির ডাক। তাঁর পোষা রাজহাঁসগুলো নদীতে দল বেঁধে সাঁতার কাটছিল। নিজের পরিচিত ফুল-ফলের গাছের বাইরেও অনেক অপরিচিত গাছও দেখতে পেলাম।

শোভা ছড়িয়ে ফুটে আছে গোলাপি রঙের জবা

ইরশাদুল জানান, বাড়িতে বাগান করতে তাঁকে বেশি উৎসাহ দিয়েছেন বড় ভাই আবু জাহিদ মো. ইবনুল ইকরাম। ‘অরেঞ্জ ভ্যালি’ নামে তাঁর একটি কমলাবাগানও আছে।

বাড়িটিতে ফলের মধ্যে জাম, আম, কমলা, মাল্টা, করমচা, আপেল, তাল, নারকেল, বেল, লটকন, খেজুর, পেয়ারা, বরই, পেঁপে, কলা, লেবু ও কাঁঠালগাছ রয়েছে। এ ছাড়া আছে তুলসী, বাসক, পুদিনা, শতমূল, আকন্দ ও শজনেগাছ।

গাছের পরিচর্যা ইরশাদুল মূলত একাই করেন। তবে মাঝেমধ্যে সহযোগিতা করেন স্ত্রী কাজী সোনিয়া ও মেয়ে সারাহ ইরশাদ। সারাহ স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। ছেলে ফারিস সাব্রিয়ান ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন।

একসময় শিয়াল, দেশি মুরগি ও চায়না হাঁস পালন করেছেন জানিয়ে ইরশাদুল বলেন, কাজের মানুষের অভাবে এসব পালন করা বর্তমানে বন্ধ করে দিয়েছেন।

এই কৃষি উদ্যোক্তার বাড়িতে রয়েছে শিউলি, চার ধরনের জবা, বকুল, কৃষ্ণচূড়া, সাত ধরনের গোলাপ, কামিনী, গন্ধরাজ, বেলি, অপরাজিতা, টাইম ফ্লাওয়ার, মে ফ্লাওয়ার, নাইট কুইন, জারবেরা, পর্তুলিকা, জেসমিন, কাঠগোলাপ, অ্যারাবিয়ান জেসমিন, রঙ্গনসহ আরও কয়েক ধরনের ফুলের গাছ।

মাল্টাসহ বেশ কয়েক জাতের ফলের গাছ রয়েছ বাড়িটিতে

ইরশাদুলের স্ত্রী বলেন, ‘আমার স্বামী স্বাধীনচেতা মানুষ। চাকরি পছন্দ করত না। সে নিজেই শহর থেকে গ্রামে চলে এসে ইচ্ছেমতো খামার করেছে, মিল করেছে, গাছপালা লাগিয়েছে। আমিও ওর সঙ্গেই এসেছি। দুজনের একসঙ্গে সংগ্রাম। আমার এখন শহরে জীবনের থেকে গাছপালাযুক্ত প্রকৃতির মাঝেই থাকতে বেশি ভালো লাগে। নিজের গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়ার অনুভূতিটা অন্য রকম।’

যে কেউ এলে বাড়িটি খুব পছন্দ করে বলে জানাল ইরশাদুল-সোনিয়া দম্পতির মেয়ে সারাহ। সে বলল, ‘ছোটকাল থেকেই আব্বু-আম্মুকে দেখে আসছি, তাঁরা দুজনেই প্রকৃতিপ্রেমী। আমিও ছোটকাল থেকে দেখতে দেখতে প্রকৃতিপ্রেমী হয়ে গেছি।’

কথায় কথায় ইরশাদুল জানান, তাঁর ইচ্ছা আছে দেশি যেসব প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ করে একটি চিড়িয়াখানা করার।