ধুলা আর ধোঁয়ার বিপদ থেকে ঢাকার বাতাস মুক্ত হচ্ছে না। একের পর এক প্রকল্প নেওয়ার পরও দূষণের উৎস রয়েই যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে জনজীবন বিষাক্ত বাতাসে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গতকাল দুপুরে শ্যামপুরে
ধুলা আর ধোঁয়ার বিপদ থেকে ঢাকার বাতাস মুক্ত হচ্ছে না। একের পর এক প্রকল্প নেওয়ার পরও দূষণের উৎস রয়েই যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে জনজীবন বিষাক্ত বাতাসে আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। গতকাল দুপুরে শ্যামপুরে

টাকা ব্যয় হয়, দূষণ কমে না

দুই প্রকল্পে বড় অঙ্কের ব্যয়ের পর ২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আরেক প্রকল্প।

ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেছে সরকার। কিন্তু নির্মল বায়ুতে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পায়নি এই শহরের শিশুরা। উল্টো দূষণের কারণে নানা বয়সের মানুষ ভুগছে বিভিন্ন রোগে। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বায়ুদূষণ রোধে সরকার ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুটি প্রকল্পে অন্তত সাড়ে ছয় কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে, যা বর্তমানে প্রায় ৭২০ কোটি টাকার সমান। এর বাইরে ছোট ছোট কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।

প্রকল্প নেওয়ার আগে বলা হয়েছিল, ‘দেশের বায়ু মান খারাপ’। প্রকল্পের মাধ্যমে বায়ুকে ‘নির্মল’ করা হবে। অথচ বিশ্বের শীর্ষ দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় ওপরের দিকেই থাকে ঢাকা। 

বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে রাত সোয়া ১০টায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল ৩ নম্বরে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ের গড় হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় ৫ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। 

বায়ুদূষণ রোধে সহায়ক হয়, এমন প্রকল্পে বিপুল অর্থায়নও পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের প্রভাবশালী সাময়িকী ল্যানসেট–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ধরনের প্রকল্পে প্রায় ২০০ কোটি (দুই বিলিয়ন) ডলারের অর্থায়ন পেয়েছে বাংলাদেশ, যা বর্তমান বিনিময় মূল্যে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার সমান। 

বায়ুদূষণ রোধ নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, দূষণ রোধে অর্থ ব্যয় হলেও ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দেওয়া হয়নি। ফলে দূষণ রোধ করা যায়নি। পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে নামকাওয়াস্তে। তারা নিজেদের তৈরি নির্দেশিকা মানাতে পারেনি। আদালতের নির্দেশনাও মানা হয়নি। 

যেমন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় সামলানোর জন্য দুজন মন্ত্রী রয়েছেন। একজন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন, অন্যজন উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার। বায়ুদূষণ নিয়ে হাবিবুন নাহার গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজ। তারা সেই কাজ সঠিকভাবে করবে বলে আশা করি।’

প্রকল্পে কী হয়

বায়ুদূষণের কারণ মূলত অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫ ও ১০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণা কেন্দ্রের হিসাবে, ধুলা ও ধোঁয়া ঢাকার বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ভূমিকা রাখে। এ ধুলার বড় উৎস অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নির্মাণকাজ, পুরোনো যানবাহনের দূষিত বায়ু। আর ৪০ শতাংশ দূষণের উৎস খড়, কাঠ, তুষের মতো জৈব বস্তুর ধোঁয়া ও সূক্ষ্ম বস্তুকণা। এর বাইরে সীমান্তের ওপার থেকেও দূষিত বায়ু আসে। 

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে বায়ুর মান ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (একিউএমপি) নামের একটি প্রকল্প নেওয়া হয় ২০০০ সালে। পরিবেশ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সূত্র বলছে, এতে ৩৫ লাখ মার্কিন ডলার ঋণসহায়তা দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।

বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রকল্প নথি অনুযায়ী, এ প্রকল্পের দুটি অংশ ছিল। একটি অংশে যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিঃসরণ কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। যার মধ্যে রয়েছে বেশি দূষণকারী ইঞ্জিনচালিত (দুই স্ট্রোক) যানবাহন শনাক্ত করা ও সড়ক থেকে তুলে নেওয়া। দ্বিতীয় অংশে বায়ুর মান পর্যবেক্ষণে সরঞ্জাম বসানোর কথা বলা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পটি ২০০৭ সাল পর্যন্ত চলেছে। এরপর বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়, যার শিরোনাম নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস)। এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক প্রায় ৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা দেয়।

বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইটে থাকা নির্মল বায়ু প্রকল্পের নথিতে দেখা যায়, এই প্রকল্পের বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বাড়ানো ও যানবাহন থেকে দূষণ কমাতে ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া হয়। 

নির্মল বায়ু প্রকল্প শেষ হয়েছে ২০১৯ সালে। এ প্রকল্প নিয়ে ২০১৯ সালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময় পর্যন্ত প্রকল্পের আওতায় ২২১ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। এর অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে প্রশিক্ষণের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর, পরামর্শক ফি, গাড়ি কেনা ও ভবন নির্মাণে। প্রকল্পের অধীনে ১০ বছরে ২৯৬ জন কর্মকর্তা বিদেশে প্রশিক্ষণে যান। একজন কর্মকর্তা ১০ বারও বিদেশে গিয়েছেন।

বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের নেওয়া প্রকল্প ও উদ্যোগগুলো সম্পর্কে আমাদের পর্যালোচনা মন্ত্রণালয়ের কাছে তুলে ধরেছি। তারা সেখান থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে বায়ুদূষণ রোধে উদ্যোগ নেবে, এটাই আশা করি।’ তিনি বলেন, ‘আগের উদ্যোগগুলোতে যেসব ভুল ও অনিয়ম হয়েছে, ভবিষ্যতে সেগুলো হবে না বলে আশা করি।’ 

এত সব অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রকল্পের পরও কেন বায়ুদূষণ কমছে না, তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান দরকার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক

সরকার পিছু হটছে

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নেওয়া প্রকল্প দুটিতে বায়ুর মান বাড়াতে দূষণকারী যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, উন্নত মানের জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, দূষণকারী ইটভাটা নিয়ন্ত্রণসহ নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় কালো ধোঁয়া নিঃসরণকারী অনেক পুরোনো বাস চলাচল করে। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০০৪ সালের দিকে ঢাকার রাস্তা থেকে পুরোনো অটোরিকশা তুলে নেওয়া হয়। নামানো হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তখন ঢাকার বায়ুর মান সাময়িক উন্নত হয়েছিল। ২০০৯ সালের দিকে ঢাকায় ১৫ বছরের পুরোনো বাস চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। নতুন করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে। তবে মালিকদের চাপে সেই প্রজ্ঞাপন আর কার্যকর হয়নি।

২০০৮ সালের দিকে ঢাকার বাসগুলোকে সিএনজিচালিত বাসে রূপান্তর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বায়ুদূষণ কমাতে। এখন বাস বেশির ভাগ চলছে ডিজেলে। এসব বাস ব্যাপকভাবে কালো ধোঁয়া নিঃসরণ করে। এদিকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) গত জানুয়ারিতে উচ্চমাত্রার সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির সুযোগ দিয়ে মানমাত্রায় ছাড় দেয়। বেশি সালফারযুক্ত ডিজেল বায়ু দূষণ করে।

দূষণকারী ইটভাটাও বাড়ছে। পরিবেশমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন গত জানুয়ারিতে সংসদে জানান, ২০২২ সালের জুনে সারা দেশে মোট ইটভাটা ছিল ৭ হাজার ৮৮১টি, যার ৬০ শতাংশই অবৈধ।

এমন পরিস্থিতিতে বায়ু, পানিদূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশে টেকসই পরিবেশ ও রূপান্তর’ শিরোনামে আরেকটি প্রকল্প নিয়েছে। এতে ২৫ কোটি ডলার (২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা) অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। নানা রোগের কারণ এই বায়ুদূষণ। 

১৭ শতাংশ অর্থায়ন বাংলাদেশে

ঢাকার মেট্রোরেল, উড়ালসড়কের মতো প্রকল্পগুলো পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণ কমাতে ভূমিকা রাখে। গত অক্টোবরে ল্যানসেট–এ প্রকাশিত ‘আন্তর্জাতিক অর্থায়ন পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণ রয়ে গেছে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ এ ধরনের প্রকল্পে ২০০ কোটি ডলার অর্থায়ন পেয়েছে, যা বৈশ্বিক মোট অর্থায়নের ১৭ শতাংশ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, এত সব অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রকল্পের পরও কেন বায়ুদূষণ কমছে না, তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান দরকার। তিনি আরও বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে আসা বায়ু, লাকড়ির চুলায় রান্না, পুরোনো যানবাহন ইত্যাদি বায়ুদূষণের কারণ। এসব উৎস বন্ধের কাজ এককভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষে  করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, এ জন্য জাতীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এবং আঞ্চলিক উদ্যোগ দরকার।

সমন্বিত উদ্যোগ নিতে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় গত বছর নভেম্বরে। ২৯ সদস্যের কমিটিতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ ১৪ জন সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ অন্যরা রয়েছেন। কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় গত ১৯ নভেম্বর। কার্যবিবরণী অনুযায়ী বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, বায়ুদূষণ রোধে অনেক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেক সরকারি অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না।

মানুষের মৃত্যু

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষ মারা গেছে। নানা রোগের কারণ এই বায়ুদূষণ। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বায়ুদূষণ রোধে শুধু প্রকল্প নিলে হবে না, দরকার কার্যকর ব্যবস্থাপনা। 

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক এম কামরুজ্জামান মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণ রোধে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরে পানি ছিটানো ও রাস্তা পরিষ্কার রাখার কাজ করতে প্রকল্প লাগে না। মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধ করতে দেশের বিদ্যমান আইনই যথেষ্ট। কথা হলো, সেটা করতে হবে।