টানা ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় বাড়িঘর ও অন্যান্য অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দুর্যোগবিষয়ক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের।
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ ঝড় হিসেবে যতটা না ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে এর প্রভাবে প্রবল বৃষ্টির কারণে। সরকারি হিসাবে দেশের অন্তত ১৩টি জেলায় ক্ষত রেখে গেছে মিধিলি। যার বড় অংশই মূলত ভারী বৃষ্টির কারণে।
বাংলাদেশ উপকূলে গত শুক্রবার আঘাত হানা ওই ঝড়ে ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় টানা ভারী বৃষ্টি থাকায় কাঁচা বাড়িঘর এবং অন্যান্য অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন দুর্যোগবিষয়ক দেশি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের প্রাথমিক হিসাবে ঘূর্ণিঝড় মিধিলি দেশের ১৩টি জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখে গেছে। এর মধ্যে খুলনা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও শরীয়তপুরে সম্পদের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এসব জেলায় সরকারিভাবে ত্রাণসহায়তা দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির আরও বিস্তারিত হিসাব করতে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে জরিপ শুরু হয়েছে বলে অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক হিসাব তৈরি করে যেখানে যে পরিমাণ ত্রাণসহায়তা দরকার, তা পাঠিয়েছি। তবে স্থানীয় পর্যায় থেকে আরও বিস্তারিত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সহায়তা দেওয়া হবে।’
জাতিসংঘের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইউএন-ওচার প্রাথমিক হিসাব বলছে, মিধিলির কারণে প্রায় দেড় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিধিলির প্রভাবে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে ১০০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় গড়ে ৭৬ কিলোমিটার। বাতাসের গতির চেয়ে টানা দুই দিন ধরে বৃষ্টি ঝরায় এবং বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি থাকায় ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে গেছে।
বৈশ্বিক সংস্থা গ্লোবাল ডিজাস্টার অ্যালার্ট অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশন সিস্টেমের (জিডিএসিএস) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড় মিধিলি মাঝারি মাত্রায় ক্ষয়ক্ষতি করেছে। ঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় গড়ে ৭৪ কিলোমিটার। আর জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল ১ দশমিক ৬ মিটার।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বলছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে শরীয়তপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালী, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ফেনী, ভোলা ও বরগুনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে এই দুর্যোগে দুর্গত মানুষের সংখ্যা ৯৪ হাজার ৫৭৭। এ ছাড়া ৩ হাজার ৬৭০টি বাড়িঘর আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঝড়ে মোট তিনজন মারা গেছেন, আর একজন নিখোঁজ রয়েছেন।
তবে বেসরকারি হিসাবে মিধিলিতে প্রাণ গেছে সাতজনের। এর মধ্যে কক্সবাজারের টেকনাফে বসতঘরের মাটির দেয়ালধসে একই পরিবারের চারজন মারা যান। আর গাছের ডাল ভেঙে পড়ে চট্টগ্রামে দুজন ও টাঙ্গাইলে একজনের মৃত্যু হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ঘূর্ণিঝড়ে দেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৭ শতাংশ আমন ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া ডালজাতীয় ফসল, শর্ষে, তেলজাতীয় ফসল ও শীতকালীন সবজির ক্ষতিও হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মাছের ঘেরেরও। তবে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ হিসাব এখনো হয়নি।
পটুয়াখালীর কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ায় জেলায় রোপা আমনের ৭৫ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ১ লাখ ৮০ হাজার হেক্টর রোপা আমন মিধিলির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া খেসারিসহ মাঠে থাকা সবজিরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
মিধিলির প্রভাবে টানা বৃষ্টিতে ডুবে যায় বাগেরহাটের কয়েক হাজার হেক্টর জমির বীজতলা। বরগুনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, বৃষ্টির ফলে শীতকালীন সবজি ও খেসারি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এই ঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়গুলো খুব বেশি দৃশ্যমান হিসাবে পাওয়া যাবে না। যেমন সেতু ভেঙে পড়েছে, গাছ উপড়ে গেছে বা বাড়িঘর ধসে গেছে। কারণ, এই ঝড়ের মূল ক্ষতি করেছে দেশের বেশির ভাগ এলাকাজুড়ে চলা টানা ভারী বৃষ্টি।
ওই বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন, শীতকালীন ডাল, সবজি ও তেলজাতীয় ফসল মাত্রই চাষ করেছিলেন কৃষকেরা। এগুলো একবার ক্ষতিগ্রস্ত হলে দ্বিতীয়বার চাষ করে আর আগের মতো ফলন পাওয়া যায় না। তাই ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের চিহ্নিত করে সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করা দরকার।