সেদিন ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ৪১৫ কোর্সের বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র৵ নিয়ে মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষণ এবং বন্য প্রাণী জরিপ ক্লাস ছিল। সেই সুবাদে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এবং বন্য প্রাণী শাখার শিক্ষক মাহবুব আলম ও ফজলে রাব্বিকে নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টায় কার্জন হল এলাকায় একটি ফিল্ড স্টাডি করার জন্য বের হই। চারদিক থেকে ভেসে আসছিল পাখির কলরব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সামনে একটি বড় পুকুর রয়েছে। এই পুকুরপাড় থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। কিছু দূর এগোতেই চোখে পড়ল, একটি ছোট মাছরাঙা পুকুর থেকে মাছ শিকার করে ডালে বসে খাচ্ছে। পুকুরপাড়ের বাগানের একটি গাছে সোনালি–পিঠ কাঠঠোকরা গাছের বাকলে পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছে। দূর আকাশে খেলা করছিল ভুবনচিলের দল। মা দোয়েল তার বাচ্চাকে পরম স্নেহে খাবার খাওয়াচ্ছিল। তা ছাড়া আরও চোখে পড়ল জালালি কবুতর, ভাতশালিক ও গোশালিকের দল, লালপুচ্ছ বুলবুল, চড়ুই, হলদে পাখি, সবুজ টিয়া ও একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাঁচ–ডোরা কাঠবিড়ালিও।
পর্যবেক্ষক দল একটু সামনে এগোতেই সৌভাগ্যবশত কার্জন হলের দ্বিতীয় গেটের কিছুটা পূর্বে ডান দিকের নির্জন জায়গাটিতে একটি মাঝারি আকারের আমগাছের ডালে একটি ছোট্ট পাখি দেখতে পেলাম। জায়গাটি ঠিক প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের সামনের বোটানিক্যাল গার্ডেনে। প্রথম দেখায় দূর থেকে মনে হচ্ছিল, এটি একটি চুটকি পাখি, ইংরেজিতে যার নাম ‘ফ্লাইকেচার’। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী উজ্জ্বল দাসকে তার নাইকন ক্যামেরা দিয়ে পাখিটির কিছু ভালো ছবি দ্রুত তোলার জন্য ক্লিক করতে বললাম। সে দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ক্যামেরা তাক করে পাখিটির খুব সুন্দর কিছু ছবি তুলে ফেলল। ছবিগুলো দেখে যেন শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে পাখিটিকে যথাযথভাবে চেনা যায়, এটিই ছিল ছবি তোলার উদ্দেশ্য। পরে বিভাগীয় গবেষণাগারে এসে ভালোভাবে ছবিগুলো দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না যে পাখিটি Brown-breasted Flycatcher, যার বাংলা নাম মেটেবুক চুটকি। বৈজ্ঞানিক নাম Muscicapa muttui।
আশ্চর্যের বিষয়, বিগত চার দশকে পাখি–গবেষকদের চোখে এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে এই প্রজাতির পাখি দেখা যায়নি এবং রেকর্ড হয়নি। তাই বিগত বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখি বৈচিত্রে৵র গবেষণাপত্রগুলোতে এই পাখির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
এটি মূলত বাংলাদেশের একটি ছোট কীটপতঙ্গভুক পরিযায়ী পাখি; আরও নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, এরা মূলত পান্থ পরিযায়ী পাখি। পরিযায়ী পাখিদের পরিযায়নের মৌসুম কেবল শুরু হয়েছে। এ সময় এসব পরিযায়ী পাখি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে যায় খাবার ও আশ্রয়ের খোঁজে।
আমাদের দেশে প্রায় ১৫ বা তার বেশি ধরনের ফ্লাইকেচার বা চুটকি পাখি দেখা যায়। ১৫টি প্রজাতির মধ্যে ৮টি পরিযায়ী। মেটেবুক চুটকি পাখিটির সঙ্গে খয়রা চুটকি, কালাপাশ চুটকি এবং লালবুক চুটকি পাখির অনেকটাই মিল রয়েছে। তবে ছবি দেখে পাখিটিকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আকারে চড়ুই পাখির মতো বা তার চেয়ে কিছুটা বড়—১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার; দেহ কালচে বাদামি, ডানার প্রান্ত কালো এবং ডানায় কোনো লাইন নেই। বুক ও বগল কালচে ধূসর, গলা সাদা। পিঠ জলপাই বাদামি, কোমর লালচে বাদামি, বড় চোখ, চোখের রঙ কালচে বাদামি এবং চোখের রিং সাদাটে; চোখ ও চঞ্চুর মাঝখানে ধূসর চামড়া। কালচে চঞ্চুর প্রশস্ত গোড়া হলদে;
পা হলদে।
এপ্রিল থেকে জুন মাসে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, চীনের দক্ষিণাঞ্চল এবং থাইল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এরা প্রজনন করে থাকে। প্রজনন মৌসুমে এরা ঘাস, লতাপাতা, শুকনা খড়, মস ইত্যাদি দিয়ে গাছের চিকন ডালে ‘কাপ’ আকৃতির বাসা তৈরি করে। স্ত্রী পাখিটি সেখানে প্রজনন মৌসুমে দুই থেকে চারটি ডিম দিয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ধীরে ধীরে কমছে পরিযায়ী পাখির আগমন। এর অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে পরিবেশদূষণ, অধিক হারে গাছপালা নিধন, পর্যাপ্ত গাছের অভাব, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও জলাশয় ব্যবস্থাপনার অভাব; সর্বোপরি জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন। এসব কারণে পাখির নিরাপদ আবাসস্থল বিনষ্ট হচ্ছে। কমে যাচ্ছে পাখিদের খাদ্য ও খাদ্যের উৎস।
কার্জন হলে হঠাৎ এই প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়ার অন্যতম কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পাসে মানুষের বিচরণ সীমাবদ্ধ থাকা। ভবিষ্যতে এই ক্যাম্পাসে আরও নতুন পাখির আগমন হবে, যদি ক্যাম্পাস আরও সবুজায়ন করা হয়। সে জন্য শুধু কার্জন হল নয়, পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যতটা সম্ভব দেশি গাছ রোপণ করা প্রয়োজন।
মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়