অপ্রাপ্তবয়স্ক শাহি ইগল। ভারতের রাজস্থানের ভরতপুরের পক্ষী অভয়ারণ্যে
অপ্রাপ্তবয়স্ক শাহি ইগল। ভারতের রাজস্থানের ভরতপুরের পক্ষী অভয়ারণ্যে

পরিযায়ী পাখি

সংকটাপন্ন শাহি ইগল 

প্রায় পাঁচ বছর আগের কথা। পাখি ও অন্য প্রাণী পর্যবেক্ষণ এবং ছবি তোলার জন্য ভারতের রাজস্থানে এসেছি। সফরের চতুর্থ দিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভরতপুর পক্ষী অভয়ারণ্যে গেলাম। ভোর থেকে বেলা তিনটা নাগাদ বিভিন্ন স্থানে পাখি পর্যবেক্ষণ করে অভয়ারণ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে অবস্থিত অবজারভেশন ডেকে উঠলাম। ডেকটি বেশি উঁচু নয়, মাত্র একতলার সমান। অবশ্য এখানে উঁচু ডেকের প্রয়োজনই হয় না।

মূলত টিকাবাউরির (ওয়েস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার) খোঁজে এসেছি; কিন্তু অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও ওটির দেখা পেলাম না। তবে টিকাবাউরির দেখা না পেলেও ঘরঘরি হাঁস, চামচঠুঁটো বক, সোনাজঙ্ঘা, কালোমাথা কাস্তেচরা, বড় সাদা বক ও ধূসর বকের দেখা মিলল। ওগুলোর ছবি তুলছি, এমন সময় দূর আকাশে একটি শিকারি পাখি উড়তে দেখলাম। ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে পাখিটিকে চেনার চেষ্টা করতে করতেই ওটি আমাদের বেশ কাছে চলে এল। ডেকের চারদিকে বারকয়েক চক্কর দিল। আমরাও ওটির বেশ কিছু ছবি তুললাম। পাখিটিকে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হলো না। 

পাখিটির ছবি তোলা শেষে সামনের দিকে এগোলাম। ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট পর আরেক জায়গায় একই প্রজাতির আরেকটি পাখি দেখলাম। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অভয়ারণ্যের মূল ফটকের আধা কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটির দেখা মিলল। বিকেল ৪টা ৫৭ মিনিটে অভয়ারণ্যের মাঝামাঝি এলাকায় শেষবারের মতো একটিকে দেখলাম। দুই রাতেই হোটেলে এসে শিকারি পাখিগুলোর ছবি ভালোভাবে পরীক্ষা করলাম। ছয় বছর আগে রাজশাহীর পদ্মার চরে একই প্রজাতির একটি পাখি দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। গত বছর শীতে যখন রাজশাহীর পদ্মায় কালোগলা ডুবালুর ছবি তুলছি, সে সময় পক্ষী আলোকচিত্রী ইমরুল কায়েস পদ্মার অন্য একটি চরে পাখিটির দেখা পায়; কিন্তু সেবার কায়েসের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় পাখিটিকে দেখার তথ্য পাইনি। কাজেই নিজ দেশে পাখিটি দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সম্প্রতি এই পাখির বিভিন্ন ছবি নিয়ে কয়েকজন পাখিবিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপচারিতায় একই প্রজাতির বিভিন্ন বয়সী পাখি শনাক্ত করতে পারলাম।

ভরতপুরে দেখা ও রাজশাহীতে দেখতে ব্যর্থ হওয়া শিকারি পাখিটি এ দেশের দুর্লভ ও সংকটাপন্ন পরিযায়ী পাখি এশীয় শাহি ইগল। বৃহৎ ইগল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম ইস্টার্ন/এশিয়ান ইম্পেরিয়াল ইগল। অ্যাক্সিপিট্রিডি গোত্রের ইগলটির বৈজ্ঞানিক নাম Aquila heliaca। দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপ থেকে পশ্চিম ও মধ্য এশিয়া পর্যন্ত এ পাখির প্রজনন এলাকা বিস্তৃত। শীতে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ায় পরিযায়ন করে।

প্রাপ্তবয়স্ক শাহি ইগলের দৈর্ঘ্য ৭২ থেকে ৮৪ সেন্টিমিটার। ওজনে পুরুষ ২ দশমিক ৪৫ থেকে ২ দশমিক ৭২ এবং স্ত্রী ৩ দশমিক ১৬ থেকে ৪ দশমিক ৫৩ কেজি হয়। মাথার চারপাশ ও ঘাড়ের পেছনটা সোনালি পীতাভ ও পিঠ চকচকে কালচে বাদামি। ডানা-ঢাকনির স্পষ্ট সাদা পট্টি চোখে পড়ে। ধূসরাভ লেজে থাকে কালচে প্রান্তীয় ফিতা এবং অবসারণী ও লেজতল-ঢাকনি অনুজ্জ্বল পীতাভ। চোখ বাদামি হলদে। চঞ্চু গাঢ় নীলচে, যার আগা কালচে। পা ও পায়ের পাতা হলুদ। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহ ও ডানার পালক-ঢাকনি হলদে পীতাভ। মাথা, ঘাড় ও বুকে রয়েছে লম্বালম্বি কালচে দাগ। পিঠ ও কোমর ফ্যাকাশে। কালচে লেজের আগা ফ্যাকাশে ও ডানার ওপরের অংশে থাকে সাদা ডোরা।

শীতে পাখিটি মৌলভীবাজার, টেকনাফ, বাহাদুরাবাদ ও রাজশাহীর পদ্মার চরের উন্মুক্ত এলাকায় বিচরণ করে। সচরাচর একাকী ঘুরে বেড়ায়। শিকার ধরার জন্য গাছের উঁচু ডাল, খুঁটি বা উন্মুক্ত প্রান্তরে বসে থাকে। স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি ও সরীসৃপ মূল খাদ্য। মাঝেমধে৵ অন্য শিকারি পাখির শিকার ছিনিয়ে নেয়। গ্রীষ্মকালে এরা দ্রুত ও পুনঃপুন ‘আউক-আউক-আউক...’ শব্দে ডাকে। 

প্রাপ্তবয়স্ক শাহি ইগল। ভরতপুরের পক্ষী অভয়ারণ্যে

নভেম্বর থেকে এপ্রিল প্রজননকাল। এ সময় নিজ আবাস এলাকার বড় গাছে ভূমি থেকে ৬ থেকে ৯ মিটার উঁচুতে ডালপালা দিয়ে বড় আঁটসাঁট মাচার মতো বাসা বানায়। ফ্যাকাশে–হলদে সাদা রঙের দু–তিনটি ডিম পাড়ে, তাতে বেগুনি, ধূসর বা বাদামি ছিট বা তিল থাকে। স্ত্রী-পুরুষ দুজন মিলেমিশে প্রায় ৪৩ দিন ডিমে তা দেয়। সদ্য ফোটা ছানার দেহের কোমল পালক ঝরে গিয়ে স্বাভাবিক পালক গজাতে ৩০ থেকে ৪৫ দিন লাগে। ছানাগুলো উড়তে শেখে ৬৩ থেকে ৭৭ দিনে। আয়ুষ্কাল ১৬ থেকে ১৭ বছর।

আ ন ম আমিনুর রহমান:পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিত্সাবিশেষজ্ঞ