শ্বাসকষ্টের রোগী এখন কেন এত বাড়ছে

রাজধানীর আসাদগেটের কলেজশিক্ষক নীতা রহমানের (ছদ্মনাম) গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সর্দি-কাশি হয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন, ঋতু পরিবর্তনের এ সময়টায় এমন হয়, তাই ফোনে চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেয়েছিলেন। সর্দি সারলেও কাশি আর ছাড়ে না। পরে শরণাপন্ন হন রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালের অধ্যাপকের। তিনি বেশ কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা দেন। নীতার ফুসফুসে সামান্য সংক্রমণের চিহ্ন পাওয়া যায়। চিকিৎসক নিতাকে অ্যান্টিবায়োটিক দেন। প্রায় ১৫ দিন ধরে টানা কাশিতে ভোগার পর কিছুটা সুস্থ হন তিনি।

নীতা রহমান ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকার একটি কলেজে বদলি হয়ে আসেন। এরপর থেকেই তাঁর সর্দি–কাশি বেড়ে গেছে বলে জানান। তিনি বলছিলেন, ‘আগেও সর্দি–কাশি হয়েছে। কিন্তু এতটা ভুগিনি, এবার যা হলো। চিকিৎসক বলেছেন, ধুলাবালি আর দূষণের কারণেই রোগ এত দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। করোনার সময়ে মাস্ক পরার অভ্যাস ছিল। এখন আবার মাস্ক পরতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।’

বায়ুদূষণ

শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রায় সর্বত্র শ্বাসকষ্টজনিত অসুখে ভোগা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত মার্চ মাসে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, দেশ হিসেবে ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে ছিল ঢাকা। চিকিৎসক, গবেষক, পরিবেশবিদেরা বলছেন, শ্বাসকষ্টসহ নানা অসুখের সঙ্গে বায়ুসহ পরিবেশগত নানা দূষণের সম্পর্ক আছে। এ প্রতিবেদনের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের তিনটি বড় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মহানগরের দুই হাসপাতালের গত ২ থেকে ১০ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দিন দিন শ্বাসকষ্টজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

এমন অবস্থায় আজ ৭ এপ্রিল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমার স্বাস্থ্য, আমার অধিকার।’

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যার বাড়বাড়ন্ত

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগে চার বছর ধরে আছেন সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ তৌহিদুজ্জামান। তাঁর কথা, এখন দ্বিগুণ রোগী আসেন। তাঁদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, সিওপিডি, ব্রঙ্কাইটিসের রোগী বেশি। একটা বিষয় দেখছি, রোগ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। আগে এটা হতো না। নগরীর বাড়তে থাকা দূষণের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে নিঃসন্দেহে।

রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের গত ১০ বছরের ও শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে রোগী ভর্তির তিন বছরের তথ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বৃদ্ধির চিত্র ফুটে ওঠে।

মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পয৴ন্ত ইনডোরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লাখ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তি হন ২০১৮ সালে, ১৭ হাজার ৮২১ এবং এরপরই গত বছর ১৬ হাজার ৩২৯। গত বছর (২০২৩) এ হাসপাতালের আউটডোরে রোগী ছিলেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৯ জন। এটা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এ হাসপাতালে ২০২৩ সালে ১ হাজার ৪১ রোগীর মৃত্যু হয়। ২০২০ সালের পর এ সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ।

রাজধানীর মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের গত ১০ বছরের ও শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে রোগী ভর্তির তিন বছরের তথ্যে শ্বাসকষ্টজনিত রোগ বৃদ্ধির চিত্র ফুটে ওঠে।

বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সাবেক চিকিৎসক ও বক্ষব্যাধিবিশেষজ্ঞ ডা. আবদুস শাকুর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে তো বটেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, শ্বাসকষ্ট এবং বক্ষব্যাধির রোগী অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আমাদের দূষণ যেমন বাড়ছে, রোগীও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।’

রাজধানীর শ্যামলীর ২৫০ শয্যার টিবি হাসপাতালে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রোগী ভর্তির সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত বছর ১ লাখ ৪ হাজার ৫৫৮ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৭ হাজারের বেশি। ২০২১ সালে রোগী ছিলেন ৬০ হাজার ৯৩২।

চলতি বছরে মার্চ মাসে গড়ে প্রতিদিন ৬০০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হয়েছেন বলে জানান হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, ‘মার্চ মাসে ইনডোরে সিট দিতে পারছিলাম না। আর মার্চ মাসে যেভাবে রোগী হয়েছে, তা–ও অস্বাভাবিক।’

হাসপাতালে তো বটেই ব্যক্তিগতভাবে রোগী দেখার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, শ্বাসকষ্ট এবং বক্ষব্যাধির রোগী অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আমাদের দূষণ যেমন বাড়ছে, রোগীও এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে
বক্ষব্যাধিবিশেষজ্ঞ ডা. আবদুস শাকুর খান

ঢাকার বাইরের চিত্র

ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে শ্বাসকষ্টের রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সরোজ কান্তি চৌধুরীর কাছে সাধারণত জটিল রোগীদের পাঠানো হয়। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ডা. সরোজ বলছিলেন, ‘এখন অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখতে হয়। দুই বছর আগে বা করোনার আগে এর অর্ধেক রোগী দেখতে হতো। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ বৃদ্ধি দেখছি।’

শ্বাসকষ্টের রোগী আগেও যে ছিল না তা নয়। কিন্তু ডা. সরোজ চৌধুরীর কথায়, ‘এখন দেখা যায়, যাদের আগে রোগ ছিল তাদের অসুখের মাত্রা বেড়েছে। আবার নতুন রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে।’

এখন অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী দেখতে হয়। দুই বছর আগে বা করোনার আগে এর অর্ধেক রোগী দেখতে হতো। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ বৃদ্ধি দেখছি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সরোজ কান্তি চৌধুরী

প্রায় একই রকম অভিজ্ঞতা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক রেজাউল ইসলামের। তিনি বলছিলেন, ‘আউটডোরের হিসাবটি বলতে পারব না। কিন্তু সেখানেও যে রোগী বাড়ছে তা বুঝতে পারি। কারণ, আমাকে এখন যে সংখ্যক রোগী দেখতে হয়, তা অন্তত দুই বছর আগের চেয়ে দ্বিগুণ।’

এই চিকিৎসকের তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাল ফ্লুর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে রোগী আসেন বেশি। এই কাশি সারতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ডা. রেজাউল বলছিলেন, ‘ধুলাবালুর কারণে এসব রোগী বাড়ছে বলে আমার ধারণা।’

আউটডোরের হিসাবটি বলতে পারব না। কিন্তু সেখানেও যে রোগী বাড়ছে তা বুঝতে পারি। কারণ, আমাকে এখন যে সংখ্যক রোগী দেখতে হয়, তা অন্তত দুই বছর আগের চেয়ে দ্বিগুণ
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক রেজাউল ইসলাম

দূষণে যে রোগগুলো বাড়ছে

বিশ্বব্যাংক গত ২৮ মার্চ এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে পরিবেশগত দূষণের কারণে প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর এক হোটেলে ওই দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবেদনটি তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এর সংখ্যা আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। দূষণ আছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’

দূষণ যেমন আছে, এর সঙ্গে রোগও আছে, আর তা বাড়ছে—চিকিৎসকেরাও তা–ই বলছেন।

অ্যাজমা, হাঁপানি এবং শ্বাসকষ্টজনিত অসুখগুলোর নানা কারণ থাকে। তবে বায়ুদূষণ এসব রোগ সৃষ্টিতে যেমন ভূমিকা রাখে, তেমনি এসব রোগ দীর্ঘস্থায়ী করতেও ভূমিকা রাখে, এমন মন্তব্য করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূষণজনিত কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি), ব্রঙ্কাইটিস, টনসিলাইটিস, হার্টের নানা অসুখ হতে পারে। আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, এসব রোগ বাড়ছে। করোনার সময় বিশেষ করে মাস্কের ব্যবহার বেশি হওয়ায় এসব রোগ কম হতে দেখেছি। তাই দূষণের সঙ্গে যে এসব রোগ বেড়ে গেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’