রোদ থেকে বাঁচাতে শিশুকে কাপড়ে ঢেকে নিয়েছেন অভিভাবক
রোদ থেকে বাঁচাতে শিশুকে কাপড়ে ঢেকে নিয়েছেন অভিভাবক

ঢাকায় গাছপালা ও জলাভূমি কম থাকায় তাপমাত্রা বেশি ৩ ডিগ্রি

ঢাকার ২০ শতাংশ স্থানে গাছপালা থাকা উচিত হলেও আছে মাত্র ২ শতাংশে। তুলনামূলক এক চিত্রে দেখা গেছে, ঢাকার অদূরে সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ শতাংশ এলাকায় গাছপালা ও ২২ শতাংশে জলাভূমি। এ কারণে একই সময় ঢাকার চেয়ে সেখানকার তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা পার্ক এলাকার তুলনায় ঢাকার বাণিজ্যিক এলাকায় তাপমাত্রার থাকে ২ ডিগ্রি বেশি।

অথচ ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকার কথা। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ৩২ কিলোমিটার দূরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেশির ভাগ সময় ৩ ডিগ্রি কম থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্ধেক এলাকাজুড়ে থাকা ২৭ হাজার গাছ ও প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকায় থাকা জলাভূমি তাপমাত্রা কম থাকার পেছনে ভূমিকা রাখছে। এখানে লাগানো গাছের বড় অংশ একাশিয়া ও আকাশমণির মতো আগ্রাসী প্রজাতির।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার সময় তেমন গাছপালা ছিল না। পরে পরিকল্পিতভাবে গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। ঢাকার তুলনায় এখানকার তাপমাত্রা সব সময় ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হওয়ার প্রধান কারণ বৃক্ষ। ঢাকা শহরে আমরা যদি শুধু গাছ লাগানো বাড়াতে পারি, তবু তাপমাত্রা কমানো যাবে।
—অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের পরিচালক

চলতি মাসে চূড়ান্ত করা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএসের এক গবেষণা সমীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে গবেষণাটি হয়েছে।

এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল, অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ ও পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ–আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।

কমেছে গাছ, বেড়েছে তাপমাত্রা

গবেষণা সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়, মূলত ১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকায় গাছপালা ও জলাভূমি দ্রুত কমতে থাকে আর কংক্রিটের উঁচু ভবন ও অবকাঠামো বাড়তে থাকে। ঢাকার তাপমাত্রাও দ্রুত বাড়তে থাকে এ সময় থেকে। সেই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে গরমের অস্বস্তিও।

ঢাকার মতো শহরে ২০ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা থাকা উচিত। এটি হলে শহরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু ঢাকায় তাপমাত্রা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। তাই ওই সময়ে এই শহরে বৃক্ষরাজি কী পরিমাণ কমল, তা বুঝতেই সমীক্ষাটি করা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একাধিক গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকার চেয়ে ঢাকার মতিঝিল ও ফার্মগেট এলাকার তাপমাত্রা সব সময় ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান—বৃক্ষ–আচ্ছাদিত এসব এলাকাতেও মূলত আগ্রাসী প্রজাতির গাছ বেশি। তারপরও গাছের কারণেই এসব এলাকায় তাপমাত্রা কম থাকছে।

প্রচণ্ড গরমে মাথায় পানি ঢালছেন এই রিকশাচালক

বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব প্ল্যান্ট টেক্সোনমি’তে গত বছর প্রকাশিত ‘ঢাকার লেকপাড়ের গাছের বৈচিত্র্য এবং গাছপালা’ শীর্ষক একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা গেছে, ধানমন্ডি, হাতিরঝিল ও গুলশান লেকপাড়ে ১১৮ প্রজাতির ২ হাজার ৩২২টি গাছ রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ প্রজাতির গাছ আগ্রাসী।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে কত নতুন নতুন আবাসিক এলাকা হচ্ছে; সেখানে শুধু ২০ শতাংশ এলাকায় গাছ লাগানো গেলে স্থানীয় মানুষের জন্য তাপমাত্রা সহনীয় রাখা ও ছায়া দেওয়া সম্ভব। আর পরিবেশবান্ধব গাছ লাগালে এ সুবিধা আরও বেশি।’

ঢাকায় তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণ

বন বিভাগের হিসাবে দেশের ১৪ শতাংশ এলাকাজুড়ে গাছপালা রয়েছে। আর ঢাকা শহরের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৯ শতাংশ। তবে বিশ্বের বনজ সম্পদ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’–এর চলতি মাসের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ঢাকার ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এলাকায় রয়েছে গাছপালা।

অধ্যাপক শেখ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার সময় তেমন গাছপালা ছিল না। পরে পরিকল্পিতভাবে গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। ঢাকার তুলনায় এখানকার তাপমাত্রা সব সময় ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম হওয়ার প্রধান কারণ বৃক্ষ। ঢাকা শহরে আমরা যদি শুধু গাছ লাগানো বাড়াতে পারি, তবু তাপমাত্রা কমানো যাবে। সেই সঙ্গে শহরবাসী, বিশেষ করে এখানকার নিম্নবিত্ত মানুষের জন্য ছায়া ও খাবারের জোগানও এসব গাছ থেকে আসতে পারে।’

ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং অ্যান্ড জিআইএস ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্মকালের শুরু থেকে দেড় মাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও ঢাকা শহরের তাপমাত্রার পার্থক্য পরিমাপ করেছে। বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে ১ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ের দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রাকে। তাতে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাহাঙ্গীরনগরের গড় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ দশমিক ৪৭ ডিগ্রি। ঢাকায় ছিল ৩৯ ডিগ্রি। ২০২২ সালে ছিল যথাক্রমে ৩৪ ডিগ্রি ও ৩৭ দশমিক ২৬ ডিগ্রি, ২০২৩ সালে ৩৭ ডিগ্রি ও ৩৮ ডিগ্রি এবং এ বছর (২০২৪) ৩৩ ডিগ্রি ও ৩৬ ডিগ্রি।

এ ব্যাপারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ঢাকা শহরের বিভিন্ন বস্তি এলাকা ও রাস্তার পাশে গাছ লাগানো শুরু করেছি। পর্যায়ক্রমে আরও গাছ লাগানো হবে। তবে নগরবাসীকে তাদের ছাদ, বারান্দা ও বাড়ির পাশের খালি জায়গাতেও গাছ লাগাতে হবে। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমরা ঢাকার তাপমাত্রা কমাতে পারব বলে আশা করি।’

তাপমাত্রা বেশি কমে দেশি গাছে

গবেষণা সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ একর জমির মধ্যে ৫০ শতাংশে, অর্থাৎ ৩৫০ দশমিক ৫৪ একরে এখনো গাছপালা, ঘাস ও লতাগুল্ম রয়েছে। গাছের পাশাপাশি গাছের ছায়ায় থাকা স্থানও এর আওতায় ধরা হয়েছে। আর ২২ শতাংশ অর্থাৎ ১৫৬ একরে রয়েছে জলাভূমি। আর ভবন রয়েছে ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ এলাকায়। বাকি এলাকায় অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জ’–এ প্রকাশিত ‘ঢাকা নগরের সবুজ এলাকার বর্তমান অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিবর্তন’ শিরোনামের নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়, ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে ঢাকায় ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমে গেছে। পরের বছরগুলোয় ঢাকায় গাছপালা নতুন করে বাড়েনি; বরং আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা শহরে ১৯৮৯ থেকে ২০২০ সাল অর্থাৎ ৩১ বছরে ৫৬ শতাংশ গাছপালা কমেছে। এখন এ শহরের মাত্র ২ শতাংশ এলাকাজুড়ে সমৃদ্ধ এবং পরিবেশবান্ধব প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম টিকে আছে। আর মোট বৃক্ষ–আচ্ছাদিত এলাকা রয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।

গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে ঢাকা শহরে সমৃদ্ধ বৃক্ষে আচ্ছাদিত এলাকা ছিল মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশ, যা এখন মাত্র ২ শতাংশ। এ অংশ আবার মাত্র চারটি এলাকায় সীমাবদ্ধ। প্রথমটি বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানা এবং পুরোনো বিমানবন্দর। দ্বিতীয়টি, সংসদ ভবন ও গণভবন। তৃতীয়টি, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, হেয়ার রোড, গুলিস্তান পার্ক, ওসমানী উদ্যান ও বঙ্গভবন। চতুর্থটি, পূর্বাচল নতুন শহর এলাকা। এর বাইরে ছোট কিছু পার্ক ও আবাসিক এলাকায় গাছপালা রয়েছে। শহরের বাকি এলাকায় গাছপালা খুব কম।

সমৃদ্ধ বৃক্ষ–আচ্ছাদিত এলাকা বলতে এমন সব স্থান বোঝানো হয়েছে, যেখানে উঁচু গাছ, লতাগুল্ম, ঘাস ও নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাসের উপযোগী আবহাওয়া রয়েছে। যেমন ঢাকার অনেক এলাকা খালি পড়ে থাকাকালে সেখানে ঘাস ও লতাগুল্ম জন্মে থাকে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব স্থানও দ্রুত আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়। তবে গাছ লাগানো, ছাদবাগান করাসহ নানাভাবে ওই ৩০ বছরে ঢাকার আবাসিক এলাকায় ২ হাজার ৭১ হেক্টর নতুন বৃক্ষ–আচ্ছাদিত এলাকা তৈরি হয়েছে। একই সময় কমেছে ৯ হাজার ২৭১ হেক্টর এলাকা। সে অর্থে সবুজ এলাকা কমেছে মোট ৭ হাজার হেক্টরের মতো।

বিশেষ করে শহরের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও জলাভূমির চারপাশ, রাস্তার দুপাশে এখনো অনেক গাছ লাগানোর সুযোগ আছে বলে উল্লেখ করেছেন গবেষণা দলের অন্যতম প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, গাছ রোপণের ক্ষেত্রেও প্রজাতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন প্রজাতির গাছ লাগাতে হবে, যার নিচে ঘাস ও লতাগুল্ম জন্মে। যেমন আকাশমণি, মেহগনি, রাবার, বেনজিন প্রজাতির গাছ এ দেশের মাটি, পানি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ ধরনের গাছ তাপমাত্রা কমানো বা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভূমিকা কম রাখে। যদি দেশি প্রজাতির ও ফলের গাছ লাগানো বেশি হয়, তবে তা খাদ্যের জোগান ও তাপমাত্রা কমানো—দুই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবে।