রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মায়ের সঙ্গে শিয়ালছানা
রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মায়ের সঙ্গে শিয়ালছানা

হঠাৎ দেখা শিয়ালছানা

এ বছরের ১৮ মের ঘটনা। পাখিবিষয়ক এক প্রকল্পের কাজে উত্তরার কাছে একটি সংরক্ষিত এলাকার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাছপালা ও ঝোপঝাড়পূর্ণ এলাকাটিতে সে সময় আমাদের গাড়ি ছাড়া আর কোনো যানবাহন ছিল না। চালকের পাশে বসে ছিলাম। হঠাৎই আমার চোখ ঝোপের সামনের একচিলতে জায়গাটিতে আটকে গেল। একটি প্রাণী তার তিনটি বাচ্চাকে নিয়ে খেলছে। সঙ্গে সঙ্গে চালককে গাড়ির গতি কমিয়ে জানালা খুলে দিতে বললাম। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রাণীগুলো আমাদের দেখে ফেলেছে।

প্রথমে বাচ্চাগুলো ও পরে মা ঝোপের আড়ালে চলে যেতে থাকল। ক্যামেরা সঙ্গেই ছিল। ২ মিনিট ১৮ সেকেন্ডÐ সময় পেলাম। মোট ৮৮টি ক্লিক করলাম। ওরা ঝোপের ভেতর ঢুকে গেলেও বাচ্চাগুলোর উৎসুক চোখ আমাদের দিকেই ছিল। তবে সংরক্ষিত এলাকা হওয়ায় গাড়ি থামাতে পারছিলাম না। হঠাৎ দেখলাম একটি বাচ্চা ঝোপের ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। এরপর সে ঝোপের মুখে এসে এমনভাবে বসল, যেন ছবি তোলার জন্যই পোজ দিয়েছে। হাইস্পিড শাটারে ২২ সেকেন্ডে ৩৭টি ছবি তুললাম। খোদ ঢাকা শহরে এখনো ওরা টিকে আছে দেখে ভালো লাগল।

এতক্ষণ বাচ্চাসহ যে প্রাণীটির গল্প বললাম, সে এ দেশের বহুল দৃশ্যমান স্তন্যপায়ী বন্য প্রাণী শিয়াল, শৃগাল বা পাতিশিয়াল। চতুরতা ও ধূর্ততার জন্য অনেকের কাছে শিয়াল পণ্ডিত নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম এশিয়াটিক জ্যাকেল, গোল্ডেন জ্যাকেল বা জ্যাকেল। এরা কুকুর ও নেকড়ের জাতভাই ও একই গোত্র ক্যানিডির সদস্য। বৈজ্ঞানিক নাম Canis aureus। দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত।

শিয়াল দেখতে কিছুটা নেকড়ের মতো হলেও আকারে কুকুরের চেয়ে ছোট। লেজ বাদে প্রাপ্তবয়স্ক প্রাণী ৬০ থেকে ৭৫ সেন্টিমিটার লম্বা; লেজ ২০ থেকে ২৮ সেন্টিমিটার। ঘাড় বরাবর উচ্চতা ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। ওজন ৭ থেকে ১১ কেজি। মুখ লম্বাটে। লেজ ফোলা ও সব সময় নিচের দিকে নামানো থাকে। একনজরে গাঢ় বাদামি। দেহের ওপরটা কালচে ও নিচটা হালকা বাদামি। মুখমণ্ডলের নিচ থেকে গলা পর্যন্ত সাদাটে।

এরা খোলামেলা অঞ্চলের বাসিন্দা। দিনে ঝোপঝাড় বা গর্তে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা থেকে রাতে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। সচরাচর দলে থাকলেও জোড়ায় বা একাকীও দেখা যায়। বৃষ্টির দিনে ও গর্তে বাচ্চা থাকলে দিনেও খাদ্যের খোঁজে বেরোয়। আমার কর্মস্থল গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় অর্ধশত শিয়াল রয়েছে। ওদের হরহামেশাই দিনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। আমি প্রায় রাতে থাকি; উচ্চৈঃস্বরে ‘হুক্কা-হুয়া’ বা ‘কেক-কেক-কা-হু’ ডাক শুনি।

মূলত মাংসাশী হলেও শিয়াল সর্বভুক। ইঁদুর, পাখি, হাঁস-মুরগি, গুইসাপ, সাপ, কাঁকড়া, মাছ, মরা-পচা প্রাণী, ডাস্টবিনের ময়লা, এমনকি কবর খুঁড়ে মানুষের লাশও খায়। মরা মানুষ খায় বলে মানুষের কাছে ঘৃণিত। এ ছাড়া ভুট্টা, আখ, তরমুজ, আম-কাঁঠাল, খেজুরের রস ইত্যাদিও খায়। সুযোগ পেলে দল বেঁধে দুর্বল ছাগল-ভেড়া বা তাদের ছানা ধরাশায়ী করে। একাকী পেলে মানুষকেও আক্রমণ করতে পারে। তবে কুকুরকে বেশ ভয় পায়। চালাক-চতুর হলেও কিছুটা ভিতু স্বভাবের। ঘ্রাণশক্তি প্রবল; লেজের নিচের দিকের গ্রন্থির দুর্গন্ধ দিয়ে শত্রু তাড়ায়।

শিয়াল মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বাস করে। বছরে দুবার বাচ্চা দেয়। স্ত্রী ৫৭ থেকে ৭০ দিন গর্ভধারণের পর চার থেকে ছয়টি বাচ্চা প্রসব করে। প্রায় ১২ দিনে বাচ্চাদের চোখ খোলে। বাচ্চারা গর্তের বাইরে এসে যখন খেলা করে, দেখতে বেশ লাগে, যেমনটা উত্তরা ও আমাদের ক্যাম্পাসে দেখেছি। আয়ুষ্কাল ১০ থেকে ১৫ বছর।

বর্তমানে এ দেশের প্রায় সবখানেই এরা নির্যাতনের শিকার। কাজেই সবার কাছে বিশেষ অনুরোধ, শিয়ালসহ অন্য বন্য প্রাণীদের হত্যা না করে বরং সংরক্ষণে এগিয়ে আসুন। বন্য প্রাণী আমাদের শত্রু নয়, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

  • আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি বন্য প্রাণী প্রজনন চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ