সুন্দরবনের বাঘের জন্য গত মাস ছিল বিপদের। বনের সাতক্ষীরা অংশে একটি বাঘের অর্ধগলিত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। একই অংশে পাওয়া গেছে বাঘের চামড়া। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, গত মাসেই সুন্দরবনের বাঘের প্রধান খাবার হরিণের প্রায় ৩০ কেজি মাংস আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শুধু সুন্দরবন নয়, দেশের বিভিন্ন বনভূমিতে বন্য প্রাণীদের অবস্থা কমবেশি এমনই। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পরিচালিত এক গবেষণা বলছে, দেশের মোট ১৩ জেলায় প্রকাশ্যে বন্য প্রাণী বেচাকেনা চলে। এসব জেলা থেকে বন্য প্রাণী ধরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে আনা হয়। ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে ও চট্টগ্রাম সমুদ্রপথে প্রাণী পাচার করা হয় মোটা টাকার বিনিময়ে।
জীবন্ত প্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে। আর উড়োজাহাজ ও জাহাজযোগে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে প্রাণী পাচার করা হচ্ছে। এসব প্রাণীর মধ্যে রয়েছে বেঙ্গল টাইগার, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিষধর সাপ, তক্ষক, ছোট সরীসৃপ প্রভৃতি।
বন বিভাগের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলছেন, বনভূমিগুলোতে বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচার হঠাৎই বেড়ে গেছে। গত ছয় মাসে দেশের পাঁচটি স্থানে অন্তত আটটি প্রাণী পাচারের সময় আটক হয়। ওই প্রাণীর তালিকায় রয়েছে কালো ভালুক, উল্লুক, বানর ও হনুমান। এগুলো সবই দেশের বাইরে পাচার হচ্ছিল বলে ধারণা করছে বন অধিদপ্তর।
বন্য প্রাণীর বেচাকেনা ও পাচার নিয়ে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে গবেষণা শুরু করেন আটজনের গবেষক দল। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এ গবেষণা হয়। ‘এক্সপ্লোরিং মার্কেট-বেইজড ওয়াইল্ড লাইফ ট্রেড ডাইনামিকস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনটি গত বছরের ২৫ নভেম্বর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, বন থেকে ধরে আনা জ্যান্ত প্রাণী দেশের ভেতরে কেনাবেচা ও বিদেশে পাচার হচ্ছে। আবার মৃত প্রাণীদের মাংস, হাড়, দাঁত, নখ, চামড়া থেকে শুরু করে রক্ত পর্যন্ত বাজারে বিক্রি হচ্ছে। যে প্রাণী যত দুর্লভ ও বিপন্ন, সেই প্রাণী তত বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মহাবিপন্ন প্রজাতির বেঙ্গল টাইগার, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, বিষধর সাপ, তক্ষক ও ছোট সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী এসব বাজারে বিক্রি হচ্ছে।
গবেষণাটি গবেষক মো. নাসিরউদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাচারের চাহিদা বাড়লে দেশে বন্য প্রাণীর পাচার ও হত্যা বেড়ে যায়। বাঘ, বানর, সাপ ও তক্ষক-জাতীয় প্রাণী বিদেশে বেশি পাচার হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সচেতন হলে এসব অপরাধ ঠেকানো সম্ভব।
গবেষক দলে আরও ছিলেন আরিফুল ইসলাম, তানিয়া আখতার , তাসনিম আরা , দেলোয়ার হোসেন, ক্রেইগ ফুলস্টোন, স্যাম ইনোচ ও অ্যালিসি হুগেজ। গবেষকেরা ২০১৯ সালে প্রতি মাসে একবার করে বন্য প্রাণীর বিক্রির স্থানগুলো পরিদর্শন করেছেন। এতে দেখা গেছে, ওই বছর মোট ৯২৮টি বন্য প্রাণী বেচাকেনা হয়েছে। গবেষক দলটি বন্য প্রাণী বেচাকেনার সঙ্গে যুক্ত মোট ৪২৩ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছেন। এই ব্যক্তিদের পরিচয় গোপন রেখে তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। ওই ব্যক্তিরা বন্য প্রাণী পাচার ও হত্যার কথা স্বীকার করেছেন বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গবেষকেরা বলছেন, সাধারণত বনের আশপাশের এলাকাগুলোতে বন্য প্রাণী বিক্রির প্রকাশ্য ও গোপন দুই ধরনের বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আগাম দরদাম করে তারপর পাচারকারী বন থেকে প্রাণীগুলো ধরে এনে বিক্রি করেন। সাধারণত মৃত প্রাণীর অঙ্গের তুলনায় জীবন্ত প্রাণী বেশি দামে বিক্রি হয়।
গবেষণাটিতে দেখা গেছে, জীবন্ত প্রাণী সবচেয়ে বেশি পাচার হচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারে। আর উড়োজাহাজ ও জাহাজযোগে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওসে এসব প্রাণী পাচার করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে. বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ‘দেশের বন্য প্রাণী পাচারে একটি শক্তিশালী চক্র সম্প্রতি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা চক্রটিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি। গত এক বছরে ৩ হাজার ১১টি পাখি, ১১২টি সাপ ও ৭৪৭ টি অন্যান্য প্রাণী পাচারের সময় উদ্ধার করেছে বন অধিদপ্তর।’
দেশের ভেতরে যে ১৩টি বন্য প্রাণী বেচাকেনার বাজার জরিপ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, রাঙামাটি, কক্সবাজার, বান্দরবান ও গাজীপুর।
এসব জেলা থেকে বন্য প্রাণী ধরে তার অর্ধেক আনা হয় ঢাকায়। আর এক-তৃতীয়াংশ চট্টগ্রামে। বাকিগুলো বাগেরহাট ও খুলনায় যায়। ঢাকা থেকে উড়োজাহাজে ও চট্টগ্রাম-মোংলা থেকে সমুদ্রপথে এসব প্রাণী পাচার হয় বলে ধারণা করছে গবেষক দলটি।
গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যালয়ের আশপাশের অনেক এলাকায় এসব বন্য প্রাণী বেচাকেনা হচ্ছে। যেমন ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে টঙ্গী বাজার, মোংলা বন্দরের পাশে বাগেরহাটে ও চট্টগ্রাম বন্দরের পাশের একটি এলাকায় বন্য প্রাণী বেচাকেনা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মো. ছানাউল্যা পাটওয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশের যেখানেই বন্য প্রাণী পাচার ও হত্যার খবর পাচ্ছি, সেখানেই অভিযান চালাচ্ছি। বন অধিদপ্তর ২০১২ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ৪৯ হাজার বন্য প্রাণী পাচারের সময় উদ্ধার করেছে।’
গবেষণাটিতে বলা হয়, বিশ্বে অবৈধ পণ্যের বাজারের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বন্য প্রাণী। বছরে ৩২ হাজার কোটি ডলার মূল্যের বন্য প্রাণী কেনাবেচা হয়, যার বড় অংশ ধনীদের শৌখিন চিড়িয়াখানা ও পার্কে আটকে রাখার জন্য কেনা হয়। এ ছাড়া চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বন্য প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশ খাবার ও ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বাইরে ব্যাগ, বেল্ট, গৃহশয্যা ও উপহারের সামগ্রী এবং গয়না তৈরিতে বন্য প্রাণীর চামড়া, দাঁত ও নখের বিপুল ব্যবহার আছে।
গবেষণা প্রতিবেদন আরও বলছে, দেশের ভেতরেও বন্য প্রাণীর অবৈধ বাজার গড়ে উঠেছে। দেশের বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, হাট ও বাজারে বনরুই, বেজি, সাপসহ নানা ধরনের প্রাণীর তেল, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। ক্রেতাদের বড় অংশ এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ওষুধ হিসেবে কার্যকর মনে করে।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, জীববৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে বন্য প্রাণী রক্ষা করা জরুরি। মানবজাতির বৈচিত্র্য ও নিরাপত্তার স্বার্থে এই প্রাণীদের এদের বসতি এলাকায় নিরাপদে থাকতে দিতে হবে। এদের হত্যা ও পাচার বন্ধে সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগাতে হবে।