মহাবিপন্ন ঘড়িয়াল

পদ্মা–গড়াইয়ের রূপকথা

২০১৭ সালের ১৩ আগস্ট পদ্মা নামে পুরুষ ঘড়িয়ালটিকে ছাড়া হয়
ছবি: লেখক

এপ্রিল মাসে যখন সারা দেশে প্রচণ্ড গরম, ঠিক তখনই গেলাম রাজশাহীতে পদ্মা-গড়াইয়ের সংসার দেখতে। প্রায় বছর গড়িয়ে গেছে, তাদের সঙ্গে দেখা নেই। তাই তড়িঘড়ি করে যাওয়া। পদ্মা-গড়াই থাকে রাজশাহী চিড়িয়াখানার ছোট্ট একটা পুকুরে। পদ্মা আর গড়াই হলো মিঠাপানির স্বামী-স্ত্রী কুমির বা ঘড়িয়াল।

রাজশাহীর এই ছোট্ট চিড়িয়াখানায় এখন সংস্কার চলছে। তেমন কোনো প্রাণী নেই। পদ্মা আর গড়াই রয়ে গেছে। সিটি করপোরেশনের তদারকিতে পরিচালিত এই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ ঘড়িয়াল দুটিকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে আগলে রেখেছে।

ঘড়িয়াল দেখার নেশা আমার সেই ২০০৯ সাল থেকে। গবেষণার কাজে তখন পদ্মা-যমুনা নদীসংলগ্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছি। আমার অগ্রজ গবেষক এস এম এ রশীদ এবং প্রয়াত আনিসুজ্জামান খানের সেই গবেষণার অভিজ্ঞতা ছিল দারুণ। নদীতে কোনো বুনো ঘড়িয়ালের দেখা আমরা পাইনি। তবে ঘড়িয়াল টিকে থাকার মতো প্রায় সাতটি অঞ্চলের খোঁজ পেয়েছিলাম।

গত ১৬ এপ্রিল রাজশাহী চিড়িয়াখানায় গড়াই নামের মেয়ে ঘড়িয়াল

সেসব জায়গায় এখনো ঘড়িয়াল প্রাকৃতিকভাবে ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা ফোটাতে সক্ষম। প্রজননক্ষম ঘড়িয়ালের দেখা পাইনি। কিন্তু এসব নদীতে প্রতিবছর গড়ে পাঁচ থেকে সাতটি ঘড়িয়ালের বাচ্চা জেলেদের জালে আটকা পড়ে। এগুলো মূলত ভারতের চাম্বাল নদী থেকে আমাদের দেশের নদীতে আসে।

২০১৪ সালে আইইউসিএন আর বন অধিদপ্তর মিলে পদ্মা-যমুনায় ঘড়িয়াল ফিরিয়ে আনার মিশন শুরু করে। সে সময় ঘড়িয়ালের বাস্তব অবস্থা দেখতে কয়েকটি চিড়িয়াখানায় গেলাম। গিয়ে দেখি, রংপুর আর রাজশাহী চিড়িয়াখানায় যে কটি ঘড়িয়াল আছে, তার সব কটিই মেয়ে। ঢাকার চিড়িয়াখানায় তখন সব কটিই পুরুষ ঘড়িয়াল। গত ৪০ বছরেও কেউ এই আবদ্ধ মেয়ে আর পুরুষ ঘড়িয়ালকে মেলানোর কথা ভাবেননি। অথচ এইটুকু করলেই বিলুপ্ত ঘড়িয়ালকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।

পদ্মা আর গড়াইকে একত্র করতে আমাদের চেষ্টার কোনো শেষ ছিল না। সরকারি পর্যায়ে অনেক চিঠি লেখালেখির পর অবশেষে আমরা ঘড়িয়াল বিনিময়ের অনুমতি পাই। ২০১৭ সালের ১২ আগস্ট রাজশাহী চিড়িয়াখানার কিউরেটর ফরহাদউদ্দিন একটি মেয়ে ঘড়িয়াল পুকুর থেকে ধরে ট্রাকে করে এনে হাজির হন ঢাকা চিড়িয়াখানায়।

ঢাকা চিড়িয়াখানায় দু-তিন ঘণ্টার অক্লান্ত চেষ্টায় প্রায় সাড়ে চার মণ ওজনের পুরুষ ঘড়িয়ালকে আমরা ধরতে সক্ষম হই। এরপর সারা রাত ট্রাকে করে রাজশাহী চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাই। ১৩ আগস্ট পুরুষ ঘড়িয়ালটি ছেড়ে দেওয়া হয় ছোট্ট পুকুরে। তার নাম দেওয়া হয় পদ্মা। আর যে মেয়ে ঘড়িয়ালটি পুকুরে ছিল, তার নাম রাখা হয় গড়াই।

এবার রাজশাহী চিড়িয়াখানায় শুরু হলো পদ্মা আর গড়াইয়ের রূপকথার সংসার। প্রতিবছর একবার হলেও তাদের দেখতে যাই। ফরহাদ ভাইও ফোন করে ভালোমন্দ খবর দেন। গড়াইয়ের ডিমের জন্য কত কিছুই না তারা করেছেন! পুকুরের ভেতর একটা গাছ আর মাটির ঢিপি ছিল; ভেঙে বালি ফেলা হলো।

এরপর গড়াই ডিম পাড়তে শুরু করল। কিন্তু ডিমগুলো পাড়ছিল পানিতে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ প্রাণী দুটির প্রতি আরও সদয় হয়ে এ বছর বেশখানিকটা জায়গার পুরোটায় বালি দিয়ে ভরাট করে দিল। স্বামী-স্ত্রী ভালোই কাটাল শীতটা। এল ডিম পাড়ার মৌসুম। গত ১৮ মার্চ ফরহাদ ভাই ফোন করে আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে জানালেন, গড়াই এবার বালিতে ডিম দিয়েছে।

 ১৬ এপ্রিল ঘড়িয়ালের পুকুরের খাঁচায় ঢুকলাম। গড়াই এগিয়ে এল ডিমের কাছাকছি, বালুচরে। কী অসাধারণ একটি পরিবার! তাদের ভালোবাসার সংসারে নিশ্চয় একদিন সন্তান আসবে। আর এই বাচ্চাগুলো ফিরে যাবে তাদের আপন ঠিকানা পদ্মা-যমুনায়।