দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা পরিবেশ ধ্বংস করছে। তারা দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নদী দখল, বন ধ্বংস ও পরিবেশকে বিপন্ন করছে। তাই পরিবেশবাদীদের তাদের নিজেদের দাবি তোলার জন্য জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়ে নিজেদের কথা বলতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের (বেন) জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে অধ্যাপক রেহমান সোবহান এসব কথা বলেছেন। জাতীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের উদ্বোধনী সমাবেশে রেহমান সোবহান সরাসরি উপস্থিত হতে পারেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ তাঁর বক্তব্য পড়ে শোনান।
সমাবেশে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পরিবেশকর্মীরা যোগ দেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজারখানেক পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সমবেত হয়ে ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে দেশের পরিবেশ সুরক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। দুই দিনের ওই সম্মেলনে দেশের আটটি বিভাগের পরিবেশকর্মীরা তাঁদের দাবিগুলো তুলে ধরবেন।
অনুষ্ঠানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। দেশের যেখানেই আমরা যাই, স্থানীয় মানুষেরা তাদের সমস্যা হিসেবে পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলছে। দেশের কয়েকটি গাছ, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে পরিবেশের সব উপাদানকে রক্ষার জন্য আন্দোলন করতে হয়। আমরা শুনি দেশে অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু উন্নয়ন মানে বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। এসব প্রকল্প মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে।’
অধ্যাপক রেহমান সোবহানের সঙ্গে একমত হয়ে আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে পরিবেশ রক্ষা করতে হলে ক্ষমতার সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে। ওই ক্ষমতার তিনটি স্তরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর প্রথম স্তরে রয়েছে দেশের কিছু ক্ষমতাধর কোম্পানি। যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। এর দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে সরকার, যারা বড় বড় প্রকল্পের নামে দেশের পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তবে ওই সব কোম্পানি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। আর তৃতীয় স্তরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে ওঠা জমিদারের মতো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি, যাঁরা বন ধ্বংস, নদী দখল থেকে শুরু করে সব ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটাচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, দেশে তিন ধরনের মানুষের কারণে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। এক ধরনের মানুষ হচ্ছে লোভী; দ্বিতীয়ত, নীতিহীন এবং তৃতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তারা আলাদাভাবে ও সম্মিলিতভাবে দেশের পরিবেশ ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছে। তাদের বিরুদ্ধে বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগ্রাম করার জন্য পরিবেশকর্মীদের প্রতি আহবান জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমরা প্রায়ই শুনি আগে উন্নয়ন, তারপর পরিবেশ। কিন্তু যে উন্নয়ন পরিবেশ রক্ষা করে হবে না, তা টেকসই হবে না। যেমন আমরা আজকে যে স্থানে অনুষ্ঠান করছি, সেখানে কুয়াশা নেই, কিন্তু চারপাশে ধুলা এমনভাবে ছড়িয়ে আছে, যাতে মনে হচ্ছে কুয়াশা পড়েছে। এই ধুলাযুক্ত বাতাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে তাতে রোগবালাই হবে।’ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাঁরা পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছেন, তাঁদের সংগঠিতভাবে কাজ করার আহবান জানান তিনি।
বাপার সভাপতি সুলতানা কামাল বিদেশে থাকায় অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত হতে পারেননি। সুলতানা কামালের দেওয়া লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান পরিবেশ সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব আলমগীর হোসেন। তাতে সুলতানা কামাল দেশের পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনকে আরও তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানে বেনের প্রতিষ্ঠাতা ও বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, বাপার নির্বাহী সদস্য অধ্যাপক খালেকুজ্জামন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান ও বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বক্তব্য দেন।