‘প্রকৃতিকে ভালোবাসি, ভালোবাসার তাগিদেই গাছ লাগিয়েছি। পুরস্কার পাব কখনো ভাবিনি। যে কাজের জন্য পুরস্কৃত হয়েছি, এ কাজে আমার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। আমৃত্যু আমি এ কাজগুলো করে যাব।’—এ কথাগুলো বলেন গাজীপুরের শ্রীপুরের পিয়ার আলী কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম আবুল খায়ের। দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
এ কে এম আবুল খায়েরসহ পাঁচজনকে নিসর্গপ্রেমী দ্বিজেন শর্মার নামে পুরস্কার ও সম্মাননা দেওয়া হয় আজ শুক্রবার। বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে এ আয়োজন করে সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমি ও তরুপল্লবের সভাপতি সেলিনা হোসেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার।
হাবিবুন নাহার বলেন, ‘দ্বিজেন শর্মাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে এ পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথে চলতে চেষ্টা করব। আমাদের কর্মক্ষেত্র আলাদা হলেও, পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করে যাব।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও গবেষক মফিদুল হক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক নুরুন নাহার এবং সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মাসরুর আরেফিন।
এ বছর তিন শাখায় পাঁচ নিসর্গকর্মীকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। কলেজ প্রাঙ্গণে উদ্ভিদ রোপণ ও প্রতিবেশ রক্ষায় বিশেষ অবদান রাখায় সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা নিসর্গ পুরস্কার ২০২২ পেয়েছেন এ কে এম আবুল খায়ের এবং দেশের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা জীববৈচিত্র্য পুরস্কার ২০২২ পান দুবাই সাফারি পার্কের প্রিন্সিপাল ওয়াইল্ডলাইফ স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ আলী রেজা খান। এ ছাড়া উদ্দীপনামূলক কাজের জন্য সিটি ব্যাংক-তরুপল্লব দ্বিজেন শর্মা বৃক্ষসখা সম্মাননা ২০২২ পেয়েছেন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সাময়িকী প্রকৃতির সম্পাদক মুশফিক হোসাইন, ময়মনসিংহ মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক চয়ন বিকাশ ভদ্র এবং সংগঠক, লেখক, উদ্ভিদ সংগ্রাহক কাজী হাসান। প্রথম দুজনকে দেওয়া হয়েছে ১ লাখ টাকা করে এবং বাকি তিনজনের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার টাকার চেক। এ ছাড়া ছিল স্মারক ও উত্তরীয়।
পুরস্কার পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় মোহাম্মদ আলী রেজা বলেন, ‘বন্য প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষার সব উপাদান আছে মাঠে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির চেয়ে কাজ করার মানসিকতাই জরুরি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৯ বছর ধরে দেখেছি, সেখানে গাছ কাটার নজির নেই। প্রয়োজন হলে গাছকে পুনর্বাসন করে এক জায়গা থেকে তুলে আরেক জায়গায় নিয়ে রোপণ করা হয়।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথিদের মধ্যে মফিদুল হক বলেন, ‘দ্বিজেনদার পরম্পরা বহন করে আমরা অনেক নিসর্গসৈনিক তৈরি হয়েছি। পরিবেশ নিয়ে আমাদের যে আন্দোলন, সেটা কেবল পরিবেশের নয়, মানবসভ্যতার আন্দোলন। আজ বিশ্বসভ্যতার যে সংকট, সেটা দেখিয়ে দিয়েছে যে উন্নয়ন ও পরিবেশকে আমরা পরস্পরবিরোধী করে দেখতে পারি কি না। উন্নয়নকে পরিবেশের কাছে নতজানু হতে হবে। পরিবেশের প্রতি আনত হয়েই আমরা উন্নয়নকে সার্থক করে তুলতে পারব। দ্বিজেনদাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’
আইনুন নিশাত বলেন, ‘জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তাই দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মিনি বোটানিক্যাল গার্ডেন তৈরিতে উদ্যোগী হতে হবে।’ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘পরিবেশকে টিকিয়ে রেখেও উন্নয়ন করা সম্ভব।’ মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘শিশুদের মধ্যেও গাছপালা নিয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়া দরকার। পরিবেশ রক্ষায় আমরা ব্যাংকের পক্ষ থেকে ২ লাখ গাছ বিতরণ করেছি।’ নুরুন নাহার বলেন, ‘কারও একার পক্ষে পরিবেশ ভালো রাখা সম্ভব নয়। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে পারব।’ সভাপতির বক্তব্যে সেলিনা হোসেন বলেন, ‘প্রত্যাশা করি, দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণের মধ্য দিয়ে তরুপল্লব আমাদের অনেক বড় একটি জায়গায় নিয়ে যাবে।’
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন তরুপল্লবের সাধারণ সম্পাদক মোকারম হোসেন। প্রশংসাপত্র পাঠ করেন লোপা মমতাজ ও হেনা সুলতানা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন জাহীদ রেজা নূর। ১৫ সেপ্টেম্বর ছিল নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর প্রয়াণের পর এ পুরস্কার প্রবর্তন করে প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লব।